(বাঁ দিকে) বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।
শুক্রবার এসএসকেএম হাসপাতালের চত্বরে দাঁড়িয়ে বিচারব্যবস্থার একটি অংশ এবং কলকাতা হাইকোর্টের এক বিচারপতি সম্পর্কে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে মন্তব্য করেছেন, তা কি শাস্তিযোগ্য?
নন্দীগ্রামে বিজেপির সঙ্গে সংঘর্ষে আহতদের দেখতে শুক্রবার এসএসকেএমে গিয়েছিলেন তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক। তার পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বিচারব্যবস্থার একাংশের প্রতি তীব্র আক্রমণ শানিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার নাম উল্লেখ করে ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ তথা শাসক তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, ‘‘বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা সমাজবিরোধীদের রক্ষাকবচ (প্রোটেকশন) দিচ্ছেন।’’ অভিষেক এ-ও বলেছিলেন, ‘‘এই একজন বিচারপতি শুভেন্দু অধিকারীকে রক্ষাকবচ দিয়ে রেখেছেন। ভবিষ্যতে তিনি (শুভেন্দু) কোনও অপকর্ম করলে তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা যাবে না! এফআইআর করা যাবে না!’’
তার পর থেকেই রাজনৈতিক ও নাগরিক মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে, একজন নির্বাচিত সাংসদ তথা আইনসভার সদস্য কি বিচারব্যবস্থা বা বিচারপতি সম্পর্কে এই ধরনের মন্তব্য করতে পারেন?
শনিবার ওই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘একজন সাংসদ হয়ে যদি বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে এই রকম বিষোদ্গার করেন, তা হলে আমি কী বলতে পারি! ওঁর (অভিষেকের) এই ধরনের কথার প্রতিক্রিয়া দেওয়া আমার সাজে না।’’ আইনত কিছু কি পদক্ষেপ করা যেতে পারে? জবাবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বলেন, ‘‘হাই কোর্ট এই বিষয়টিকে অবমাননাকর হিসাবে নিচ্ছে কি না, সেটা তাদের ঠিক করতে হবে। আমার মন্তব্য করা ঠিক নয়।’’
কলকাতা হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্তের বক্তব্য, ‘‘আমাদের আদালত অবমাননা আইনে দু’রকম দিক আছে। একটি দেওয়ানি, অন্যটি ফৌজদারি। যদি কোনও বিচারপতির কোনও নির্দেশ কার্যকর না হয় বা নির্দেশ লঙ্ঘন করা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট বিচারপতি আদালত অবমাননার দেওয়ানি আইনে রুল জারি করে পরবর্তী প্রক্রিয়া করতে পারেন। আর যদি দেখা যায়, কারও কোনও বক্তব্য বিচারব্যবস্থা বা বিচারপতিদের অবমাননা করছে, তা হলে আদালত ফৌজদারি মামলা করতে পারে। হাই কোর্টের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ে এই ধরনের মামলা শোনে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। হয় কেউ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন অথবা আদালত স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে সেই মামলা করে থাকে।’’ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আইনসভার একজন সদস্যের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে এই মন্তব্য কতটা সমীচীন। জবাবে তিনি বলেন, ‘‘যে হেতু আমি অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, তাই এই বিষয়ে আমার মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।’’
আইনজীবী তথা সিপিএম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এ সব ক্ষেত্রে খুব বেশি হলে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আবমননার মামলা রুজু করতে পারে। তার চেয়ে বেশি কিছু না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, আদালতের এই সব আবোলতাবোল মন্তব্য উপেক্ষা করা উচিত। না হলে যিনি বলছেন, তিনি বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে যাবেন।’’ রাজ্যসভার সিপিএম সাংসদ এ-ও বলেন, ‘‘অভিষেকের এই মন্তব্য আসলে আদালতের উপর চাপ তৈরির কৌশল।’’ আর এক বর্ষীয়ান আইনজীবী তথা কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ বলেন, ‘‘বিচারপতি বা বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে নিশ্চয়ই এই ধরনের কথা বলা যায় না। কিন্তু এটাও ঘটনা, কে কাকে দোষ দেবে! সবাই তো সমান দোষে দুষ্ট।’’ অরুণাভর কথায়, ‘‘নিয়ম হল, আদালতের মধ্যে বিচারপতিরা আইনের কথা বাদ দিয়ে অন্য কোনও কথা বলতে পারেন না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, অনেকে আইনের কথা বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত কথা বলছেন। তা প্রচারিতও হচ্ছে।’’ কটাক্ষের সুরে অরুণাভ বলেন, ‘‘এঁদের অনেকেই কেমন আইন জানেন, তা জানা আছে!’’
আর এক আইনজীবী তথা বিজেপি নেতা তরুণজ্যোতি তিওয়ারির বক্তব্য, ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় একজন লোকসভার সাংসদ। তিনি আইনপ্রণেতা। তিনি যদি এই ধরনের মন্তব্য করেন, তা হলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। আমার মনে হয় আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অবমাননার রুল জারি করা উচিত।’’ তরুণজ্যোতি আরও বলেন, ‘‘অভিষেক যে বিচারপতি সম্পর্কে বলেছেন, তিনিই প্রথম অনুব্রত মণ্ডলকে রক্ষাকবচ দিয়েছিলেন। উনি বোধ হয় সে কথা ভুলে গিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। এখন একমাত্র ভরসা আদালত। তাই অভিষেক তথা তৃণমূল নেতৃত্ব আদালতের উপর ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করতে চাইছেন।’’
প্রসঙ্গত, অভিষেক ওই মন্তব্য করার পরে এ-ও বলেছিলেন যে, ওই মন্তব্যের জন্য যদি আদালত অবমাননার দায়ে তাঁকে জেলে যেতে হয়, তিনি তাতেও পিছপা হবেন না।
(এক নির্বাচিত সাংসদের জনসমক্ষে করা মন্তব্য এই প্রতিবেদনে পুনর্বার তুলে ধরা হয়েছে মাত্র। আনন্দবাজার অনলাইনের প্রধান সম্পাদক, সম্পাদক এবং সমগ্র বার্তা বিভাগের কর্মীরা এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নন। আনন্দবাজার অনলাইনের প্রধান সম্পাদক, সম্পাদক এবং কর্তৃপক্ষের বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা এবং মাননীয় বিচারপতিদের প্রতি আস্থা, শ্রদ্ধা অটুট এবং অসীম। সম্মাননীয় পাঠক বা সংশ্লিষ্ট অন্য কেউ এই প্রতিবেদনকে কোনও ভাবেই যেন বিচারব্যবস্থা এবং বিচারপতিদের সম্পর্কে অশোভন মন্তব্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুমোদন কিংবা সমর্থন হিসেবে বিবেচনা না করেন)