শিশুশ্রমিক কই! মানতে নারাজ মন্ত্রী

শিশুশ্রম রুখতে রাজ্যে আইন রয়েছে। আছে শ্রম দফতর-সমাজকল্যাণ দফতরের একাধিক বিভাগ। রয়েছে ‘রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগ’ও। কিন্তু কাগজ-কলমে ছাড়া সেই আয়োগের যে অস্তিত্ব নেই, তা প্রমাণ হয়ে গেল পিংলার বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে আটটি শিশুর মৃত্যুতে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৫ ০৩:১৭
Share:

শিশুশ্রম রুখতে রাজ্যে আইন রয়েছে। আছে শ্রম দফতর-সমাজকল্যাণ দফতরের একাধিক বিভাগ। রয়েছে ‘রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগ’ও। কিন্তু কাগজ-কলমে ছাড়া সেই আয়োগের যে অস্তিত্ব নেই, তা প্রমাণ হয়ে গেল পিংলার বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে আটটি শিশুর মৃত্যুতে। শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক কিন্তু এর পরেও মানতে নারাজ যে, রাজ্যে আদৌ শিশুশ্রমিক আছে! পিংলার বাজি কারখানায় শিশুশ্রমকে নিছক ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলেছেন তিনি।

Advertisement

পিংলায় কী করে শিশুদের দিয়ে বাজি বানানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো হচ্ছিল, সেই প্রশ্ন তুলে মঙ্গলবার প্রশাসনকে ভর্ৎসনা করেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর মন্তব্য করেছিলেন, রাজ্যের কোথায় কী ঘটছে সে ব্যাপারে প্রশাসনের নজর নেই। পরিবেশ ও শিশু-অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারও অভিযোগ, শিশুদের পক্ষে বিপজ্জনক ১৫টি জীবিকা ও ৫৭টি পেশার বিস্তারিত তালিকা রয়েছে ১৯৮৬ সালের ‘শিশুশ্রম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইনে’। কিন্তু সেখানে শিশুদের ব্যবহার আটকানোর সদিচ্ছা নেই প্রশাসনের।

পরিস্থিতি এমনই যে, পিংলার অবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শনে যাওয়া হবে কি না, সেটাই এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি ‘রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগ’। ঘটনার এক সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পর গত ১২ মে পিংলা নিয়ে আয়োগের জরুরি বৈঠক ডাকা সত্ত্বেও মাত্র এক জন ছাড়া আয়োগের কোনও সদস্য উপস্থিত হননি। ফলে সেই বৈঠক বাতিল করতে হয়েছে। আয়োগের চেয়ারম্যান অশোকেন্দু দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘আমাদের পরিকাঠামো নেই। লোকজন নেই। একটা নজরদারির জন্য কিছু চোখ লাগে। বৈঠকের জন্য সদস্যদের উপস্থিতি লাগে। সেই সব না হলে কী করে হবে!’’ তিনি আরও জানান, আয়োগের এমন কোনও হেল্পলাইনও নেই যেখানে সাধারণ মানুষ অনিয়ম সংক্রান্ত খবর দিতে পারেন। কোনও ওয়েবসাইট নেই যেখান থেকে লোকে আয়োগ সম্পর্কে জানতে পারে। এই সরকারের আমলেই আড়াই বছর আগে তৈরি হয়েছিল আয়োগ। অভিযোগ, এখনও তা ঠুঁটো জগন্নাথ হয়েই আছে।

Advertisement

শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক তো এখনও মানতেই রাজি নন যে, পশ্চিমবঙ্গে শিশুশ্রমিক রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার নুঙ্গি-চম্পাহাটি এলাকায় বাজি কারখানায়, হাওড়া-হুগলি-বর্ধমানের ইটভাঁটায়, মুর্শিদাবাদে বিড়ি বাঁধার কাজে, রাজ্যের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে পাথর খাদানে, খনিতে, কাঠ-চেরাই কারখানায়, বিভিন্ন সোনার দোকানে, কলকাতার ধাপার মাঠে ময়লা তোলা বা মেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহের মতো ক্ষতিকর কাজে শিশুদের ব্যবহার করার কথা সবার জানা থাকলেও কেন প্রশাসনের তা নজরে আসে না?

মলয়বাবুর উত্তর, ‘‘আপনারা বললেই তো আমরা বিশ্বাস করব না। আমাকে দেখান যে শিশুরা কাজ করছে। কাউকে লিখিত অভিযোগ করতে হবে।’’ শ্রমদফতর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কেন এই সব জায়গায় অভিযান চালাবে না, সে ব্যাপারে শ্রমমন্ত্রীর জবাব, ‘‘কোন কারখানার চার দেওয়ালের মধ্যে কী হচ্ছে আমাদের পক্ষে তা ঘুরে-ঘুরে দেখা সম্ভব নয়।’’ পিংলায় শ্রমদফতরের যে দু’সদস্যের তদন্তকারী দল গিয়েছিল তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে দফতরের সচিব অমল রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘জানা গিয়েছে, ওখানে একটি পোলট্রির লাইসেন্স ছিল। বাদ বাকি বাচ্চাদের ওখানে কাজ করানোর ব্যাপারে যা ব্যবস্থা নেওয়ার তা তো পুলিশ নেবে।’’

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উদাহরণ টেনে এ দিন রাজ্যদূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, বছরখানেক আগে উত্তর ২৪ পরগনার কিছু কিশোর আসানসোলের পাথর খাদানে কাজ করতে গিয়ে সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়েছিল। সে নিয়ে বারবার করে সরকারকে জানিয়ে জেলাশাসককে চিঠি দিয়েও কোনও ফল হয়নি। কোনও পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের টাকা তারা এখনও পায়নি।

২০০১-এর জনগণনা অনুযায়ী, গোটা দেশের মোট শিশু শ্রমিকের ৭ শতাংশের বেশি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। অথচ এই রাজ্যে ২০১০ থেকে ২০১৩-র মধ্যে ‘জাতীয় শিশু শ্রমিক প্রকল্প’-এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে মেরেকেটে ১০ হাজার শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল। ওড়িশার মতো রাজ্যে সংখ্যাটা ছিল প্রায় ৩৮ হাজার। সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকেই এখন বলছেন, আর্থসামাজিক কারণে শিশুদের কাজ হয়তো পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তারা অন্তত একটু সুরক্ষিত পরিবেশে কাজ করুক, বিস্ফোরণে না মরুক, এইটুকু তো পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন দেখতেই পারে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement