Kurmi

পানীয় জলের জন্য হাঁটতে হচ্ছে পাঁচ কিলোমিটার, অনিশ্চিত হয়েছে হাসপাতালে যাওয়া, চার দিনের অবরোধে ভোগান্তি চরমে

পশ্চিম মেদিনীপুরের খেমাশুলির কাছে অবরুদ্ধ ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক। রাস্তার দু’ধারে আটকে কয়েক হাজার মালবোঝাই লরি। তার মধ্যে রয়েছে ফল, পোশাক, গ্যাস-সহ একাধিক পণ্যবোঝাই ট্রাক। বিপাকে পুরুলিয়াবাসীও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মেদিনীপুর ও পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৪:৫১
Share:

কবে চালু হবে ট্রেন, প্রশ্ন যাত্রীদের। পুরুলিয়া রেল স্টেশনে তোলা ছবি। — নিজস্ব চিত্র।

চার দিন ধরে একই জায়গায় আটকে রয়েছেন মহম্মদ আসফাক। এ ক’দিনে তাঁর লরি এক পা-ও এগোতে পারেনি কুড়মি সমাজের আন্দোলনের জেরে। পানীয় জল ঠিক মতো পাচ্ছেন না। এমনকি, খাবারদাবারও মিলছে না ভাল করে। ফলে চূড়ান্ত দুর্ভোগে পড়েছেন মধ্যবয়সি ওই ট্রাকচালক। ঝাড়গ্রামের খেমাশুলির কাছে চার দিন ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর ট্রাক। একা আসফাক নন, ৬ নম্বর জাতীয় সড়কে এমন ভাবেই দিন-রাত কাটাচ্ছেন বহু মানুষ।

Advertisement

আন্দোনকারীদের তরফে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের দাবি না-মানা পর্যন্ত কোনও ভাবেই এই অবরোধ তুলে নেওয়া হবে না। অন্য দিকে, রাজ্য প্রশাসন বা রেল— কোনও তরফই এই আন্দোলন তোলার সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। দাবিদাওয়া নিয়ে সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে বলে প্রসানিক কর্তারা দাবি করলেও, সেই কথাবার্তায় কোনও কাজ হচ্ছে না বলে দাবি আন্দোলকারীদের। আর এই দোটানার মাঝে পড়ে গত চার দিন ধরে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

শুরু হয়েছিল মঙ্গলবার ভোরে। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত কুড়মি সমাজের সেই আন্দোলন ওঠার কোনও সম্ভাবনা দেখা যায়নি। এখনও অবরোধ চলছে ঝাড়গ্রামের খেমাশুলিতে। সেখানে রেল অবরোধের পাশাপাশি চার দিন ধরে জাতীয় সড়কও আটকে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে অবরোধ চলছে পুরুলিয়ার কুস্তাউর স্টেশনে। সব মিলিয়ে একটা বিস্তীর্ণ এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাতিল করা হচ্ছে একের পর এক ট্রেন।

Advertisement

খেমাশুলির কাছে অবরুদ্ধ ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক। রাস্তার দু’ধারে আটকে পড়েছে কয়েক হাজার মালবোঝাই লরি। তার মধ্যে রয়েছে ফল, পোশাক, গ্যাস-সহ একাধিক পণ্যবোঝাই ট্রাক। মহম্মদ আসফাক যেমন বলছেন, ‘‘আমি দূরপাল্লার ট্রাক চালাই। আমার গাড়ি এখানে আটকে রয়েছে চার দিন। ঠিক মতো খাবার-জল পাচ্ছি না। খাবারও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশাসন কিছু একটা ব্যবস্থা করে এই অবরোধ তুলুক। এ ভাবে রাস্তায় ক‌’দিন আর আটকে থাকব!’’

কয়েক দিন ধরে ওই জাতীয় সড়কেই আটকে রয়েছেন বিপিন দাস। তিনি খালাসির কাজ করেন। তাঁ কথায়, ‘‘না খেতে পাচ্ছি, না জল পাচ্ছি। ৪-৫ কিলোমিটার হেঁটে গ্রামে গিয়ে চালডাল চেয়ে আনতে হচ্ছে। জল আনতে হচ্ছে। সরকারের কাছে মিনতি করছি, যাতে কোনও একটা মীমাংসা হয়।’’

শুধু ট্রাক-লরি নয়, অবরোধের কারণে ওই জাতীয় সড়কে আটকে যাত্রিবাহী প্রচুর গাড়িও। বাস চলাচল করছে না কোনও ভাবেই চলছে না। ছোটগাড়িও নয়। ফলে যাত্রীদের অবস্থা শোচনীয়। অনন্ত মাহাতোর কথায়, ‘‘বাস তো চলছেই না। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা ছোট গাড়িতে, এ সব করে যাতায়াত করতে হচ্ছে। প্রচুর সময় লাগছে।’’

ঝাড়গ্রামের মতো একই অবস্থা পুরুলিয়াতেও। যদিও প্রশাসনের দাবি, আন্দোলনে অবরোধকারীদের ভিড় আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। যদিও উৎসবের মেজাজে চলছে আন্দোলন। চার দিন ধরে রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকায় চরম হয়রানির মুখে পড়ছেন নিত্যযাত্রী থেকে রোগীর পরিবার। বৃহস্পতিবার পুরুলিয়ার হুড়ার বাসিন্দা প্রশান্ত মাহাতো রওনা দিয়েছিলেন রাঁচীর উদ্দেশে। পুরুলিয়া স্টেশনে পৌঁছে ট্রেন বাতিল শুনে মাথায় হাত তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘রাঁচীতে আজই মেয়েকে ডাক্তার দেখানোর কথা। এ দিকে এখানে অবরোধ। কী যে করি! গাড়িতে যেতে অনেক সময় লাগবে। আর অত টাকা কোথায় পাব!’’

পুরুলিয়া থেকে অনেকেই কাজের সূত্রে নিয়মিত যাতায়াত করেন বলরামপুর , চাণ্ডিল, টাটা-সহ বিভিন্ন জায়গায়। তাঁরাও পড়েছেন সমস্যায়। নিত্যযাত্রী সোমনাথ পাল বলেন, ‘‘প্রচুর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে আমাদের। অনেকের কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পুজোর আগে কাজ বন্ধ হয়ে গেলে তো সমস্যায় পড়ব!’’

সাধারণ মানুষের অসুবিধার কথা মেনে নিয়েছেন অবরোধকারীদের নেতা অজিতপ্রসাদ মাহাতো। তিনি বলেন, ‘‘অনেকের অসুবিধা হচ্ছে মানছি। কিন্তু আমাদের কথা তো আগে কেউ ভাবেনি। আমরা তো অনেক আগেই ডাক দিয়েছি রেল অবরোধের। সরকার আমাদের দাবি মেনে নিলেই তো আমরা অবরোধ তুলে নেব।’’

রেলের তরফে যদিও এই অবরোধ তোলার কোনও সদিচ্ছা দেখানো হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। পাল্টা রেলের দাবি, অবরোধ তোলার কাজ রাজ্য সরকারের। রেল সুরক্ষা বাহিনীর কাজ নয় এটা। রেলকে সুরক্ষিত রাখার কাজ ওই বাহিনীর। আদ্রার ডিআরএম মণীশ কুমার বলেন, ‘‘আশা করেছিলাম সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। এই সব ক্ষেত্রে পুরো ক্ষমতা রাজ্য সরকারের হাতে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশিকাও রয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে এই সব ক্ষেত্রে রেল হস্তক্ষেপ করবে না।’’

অন্য দিকে, পুরুলিয়া-২ ব্লকের বিডিও দেবজিৎ রায় দাবি করেছেন, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে অবরোধ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছে রাজ্য সরকার। তিনি বলেন, ‘‘আমরা চেষ্টা করছি নিরন্তর। দেখি কী হয়!’’ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আবার বৈঠকে বসা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

বুধবার আন্দোলনকারীদের একাংশ জানিয়েছেন, শুক্রবার দুপুরে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের তরফে কলকাতায় তাঁদের আলোচনায় ডাকা হয়েছে। যদিও কুড়মি সমাজের কেন্দ্রীয় সভাপতি শশাঙ্কশেখর মাহাতো পাল্টা ‘হুঙ্কার’ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘যত ক্ষণ না পর্যন্ত আমরা ইতিবাচক চিঠি পাচ্ছি তত ক্ষণ আন্দোলন জারি থাকবে। আমরা আলোচনার জন্য কলকাতা যাব না। সরকারের প্রতিনিধিদের এখানে আসতে হবে।’’ তাঁর মতে, স্থানীয় প্রসাশনের সঙ্গে আলোচনা হলেও, তা এখনও এমন পর্যায়ে পৌঁছয়নি যে আন্দোলন তুলে নেওয়া যায়। তাই আন্দোলন চলবে বলেই জানিয়েছেন তিনি। এই আবহে খেমাশুলির পাশাপাশি শুক্রবার দুপুর থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে নতুন করে রেল রোকো শুরু করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।

যদিও পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক আয়েশা রানি বলেন, ‘‘শালবনি স্টেশনে যাতে অবরোধ না করে সে জন্য কুড়মি সমাজের নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। একটি প্রতিনিধি দল গিয়েছে এলাকায়। মানুষের ভোগান্তির কথা তাদের জানানো হয়েছে। তা ছাড়া ওদের দাবি নিয়ে সরকারের সঙ্গেও আলোচনা চলছে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement