নিজের বাড়ির সামনে লঙ্কা ঘোষ। রবিবার।—নিজস্ব চিত্র।
নিজেকে তিনি দাবি করেছেন তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী বলে। আর তৃণমূল সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তিনি দলের কেউ নন, সমাজবিরোধী।
পুলিশ বলছে তিনি এলাকায় নেই। কিন্তু এলাকাবাসী বলছেন, তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন বাড়িতেই।
রবিবারের পড়ন্ত বেলায় পুলিশের চোখে ‘পলাতক’ সেই লঙ্কা ঘোষের (যিনি কৃষ্ণগঞ্জ ঘুঘড়াগাছিতে রবিবার লঙ্কা-কাণ্ড বাধিয়েছেন বলে অভিযোগ) দেখা মিলল এলাকাতেই! এবং সাফ জানিয়ে দিলেন, তিনি তৃণমূল করেন। দলের নেতারাও তাঁকে চেনেন।
ঘুঘড়াগাছিতে ২২ বিঘা জমির দখলকে ঘিরে এ দিন সকালে গুলিতে নিহত হয়েছেন এক মহিলা। এক স্কুলছাত্র-সহ গুলিবিদ্ধ আরও তিন জন। ঘটনার পরে যে সাত জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে, এই লঙ্কা তাঁদের অন্যতম। স্থানীয় বাসিন্দাদের বড় অংশেরই অভিযোগ, তৃণমূলের প্রশ্রয়ে লঙ্কা ও তাঁর দলবল বেশ কয়েক মাস থেকেই ওই জমি দখল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। তার দখল নিতেই এ দিন বোমা-বন্দুক নিয়ে হামলা চালিয়েছিল লঙ্কারা।
কে এই লঙ্কা?
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, এক সময়ের গরু পাচারকারী। এখন জমি বেচাকেনার কারবারেও হাত পাকিয়েছেন। তৈরি করেছেন নিজস্ব সিন্ডিকেট। খাতায়-কলমে তিনি লঙ্কেশ্বর ঘোষ। গরু পাচারকারীদের কাছে অবশ্য স্রেফ লঙ্কা। আর জমি কারবারে তিনিই লঙ্কাদা। সেই লঙ্কার ঝাঁঝে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল না খেলেও তাঁকে সমঝে চলে পুলিশ থেকে শুরু করে রাজনীতির কারবারিরাও। বছর ষাটের লঙ্কার বাড়ি কৃষ্ণগঞ্জের একেবারে সীমান্তঘেঁষা গ্রাম নাথপুরে। মাস সাতেক আগে পুরনো কাঁচা বাড়ি ভেঙে পেল্লাই বাড়ি তৈরি করতে শুরু করেছেন তিনি। তা নিয়ে পড়শিদের চাপা ফিসফাস, “হাতে যে অনেক টাকা এসেছে। বাড়ি তো হাঁকাবেই!”
কিন্তু হঠাৎ এত পয়সা কোথা থেকে এলো? লঙ্কার স্ত্রী রেখারানি ঘোষ বেশ ক্ষুব্ধ হয়েই বলেন, “বিঘে দশেক আবাদি জমি রয়েছে। গোয়ালে গরু আছে। সে সব করে বাড়িটা যেই পাকা করতে শুরু করেছে অমনি সবার চোখ টাটাচ্ছে!” তবে এই বিপুল পয়সা যে শুধু গোয়ালের গরু কিংবা জমি থেকে আসেনি, সে কথা জানে গোটা নাথপুর। কয়েক জন গ্রামবাসীর কথায়, “লঙ্কা কী ভাবে সম্পত্তি বাড়িয়েছে, তা আর চাপা কিছু নয়।”
এ তো গেল জনশ্রুতি। লঙ্কা নিজে কী বলছেন? এ দিন হামলার পরে পুলিশ বেশ কয়েকবার নাথপুরে হানা দিয়েছে। নিজস্ব ‘নেটওয়ার্কের’ সৌজন্যে লঙ্কা সে খবর পেয়েছেন আগেই। লঙ্কার বাড়ির সামনে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল লোকজনের ভিড়। সাংবাদিক জেনে ভিড় ফুঁড়ে বেরিয়ে এলেন গাট্টাগোট্টা চেহারার ‘পলাতক’ লঙ্কেশ্বর। চকিতে আশপাশটা দেখে নিয়ে বললেন, “আমিই লঙ্কা। কী জানতে চান বলুন?”
গরু পাচার কিংবা বেআইনি জমি কারবারের অভিযোগ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে উড়িয়ে লঙ্কার দাবি, “ছাড়ুন তো মশাই, পাড়া-গাঁয়ে কত লোকে কত কথা বলে। সে সব বিশ্বাস করলে চলে না কি? সবই হিংসা!”
তাঁর দাবি, গত এক বছরে এই গ্রামে বিঘে ষাটেক জমি তিনি বেচাকেনা করেছেন। কোনও অসুবিধা হয়নি। ঘুঘড়াগাছির ওই ২২ বিঘা জমিও তিনি বছর দু’য়েক আগে কিনতে চেয়েছিলেন। সেই মতো কথাবার্তাও এগিয়েছিল। কিন্তু সেই জমি নিয়ে বিস্তর বিতর্ক থাকায় তিনি পিছিয়ে এসেছিলেন। যদিও গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, পিছিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, সেই সময় থেকেই লঙ্কা ও তাঁর দলবল ওই জমিটি দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ওই জমিতে চাষ করা লোকজনকে নানা ভাবে হুমকি ও বেশ কয়েক জনকে তিনি মারধরও করেছিলেন। তা নিয়ে থানা-পুলিশও হয়। পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ।
কেন? নিহত ও আহতদের পরিবার এবং এলাকাবাসীর একাংশ বলছেন, “যে লোকটা তৃণমূলের প্রশ্রয়ে এই এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তার বিরুদ্ধে পুলিশ আবার কী ব্যবস্থা নেবে? লঙ্কার সঙ্গে যে তৃণমূলের উপর মহলেরও ভাল খাতির রয়েছে।” সে কথা অবশ্য নিজেও কবুল করছেন লঙ্কা, “হ্যাঁ, আমি তৃণমূল করি। নেতারাও আমাকে চেনেন। এতে অন্যায় কী আছে?” লঙ্কার দাবি যে মিথ্যে নয় তা স্পষ্ট হয়ে যায় কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোষচৌধুরীর কথাতেও। লক্ষ্মণবাবু বলেন, “জমি দখলকে কেন্দ্র করে যাঁদের নাম উঠে আসছে তাঁদের মধ্যে লঙ্কাকে আমি চিনি। তবে লঙ্কা তো গরু পাচারকারী, সমাজবিরোধী। তাই তাঁকে আমাদের দলের কাছাকাছি ঘেঁষতে দিইনি।”
যা শুনে লঙ্কা তো বটেই আকাশ থেকে পড়ছে গোটা গ্রাম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনা কয়েক গ্রামবাসীর কথায়, “সব ভোটেই তৃণমূলের হয়ে জান লড়িয়ে দেয় লঙ্কা। এ দিনের জমি দখলকে কেন্দ্র করে লঙ্কার দলবল যা করল তা তৃণমূলের নেতাদের প্রশ্রয় ছাড়া সম্ভবই নয়। এখন বিপদ বুঝে লঙ্কার সংস্রব এড়াতে চাইছে তৃণমূল।”
নদিয়া জেলা বিজেপির মুখপাত্র সৈকত সরকার বলেন, “লঙ্কার সঙ্গে লক্ষ্মণবাবুর যোগাযোগ রয়েছে কি না, তা পুলিশ তাঁদের মোবাইল ঘাঁটলেই তো পেয়ে যাবে। আর শুধু একটা লঙ্কা নয়, তৃণমূলের নীচ থেকে উপর তলায় এ রকম অসংখ্য লঙ্কা রয়েছে। এখন সেই লঙ্কাদের চিনি না বললে তো মানুষ শুনবেন না।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলছেন, “লঙ্কা ঘোষ-সহ অভিযুক্তরা সকলেই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ। শাসক দলের প্রত্যক্ষ মদতে পরিকল্পিত ভাবে এই ঘটনা ঘটেছে।”