সামাল দিতে নামল র‌্যাফ

সাতসকালেই তুলকালাম! রাস্তা জুড়ে দু’দল লোক রড-লাঠি নিয়ে মারামারি করছেন আর তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে বেধড়ক লাঠি চালাচ্ছে র‌্যাফ। শনিবার সকালে এই দৃশ্য দেখে রীতমতো হতচকিত নিউটাউনের রামকৃষ্ণপল্লির বাসিন্দারা। একই সঙ্গে আতঙ্কিতও। তাই চোখের সামনে মারামারি দেখে কেউ চটজলদি জানলা-দরজা বন্ধ করে ঘরে সেঁধিয়ে গিয়েছেন, কেউ বা বিপদ বুঝে ঘুরপথে অফিসের দিকে রওনা হয়েছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৪ ০৩:২৬
Share:

সাতসকালেই তুলকালাম! রাস্তা জুড়ে দু’দল লোক রড-লাঠি নিয়ে মারামারি করছেন আর তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে বেধড়ক লাঠি চালাচ্ছে র‌্যাফ। শনিবার সকালে এই দৃশ্য দেখে রীতমতো হতচকিত নিউটাউনের রামকৃষ্ণপল্লির বাসিন্দারা। একই সঙ্গে আতঙ্কিতও। তাই চোখের সামনে মারামারি দেখে কেউ চটজলদি জানলা-দরজা বন্ধ করে ঘরে সেঁধিয়ে গিয়েছেন, কেউ বা বিপদ বুঝে ঘুরপথে অফিসের দিকে রওনা হয়েছেন।

Advertisement

পুলিশ জানিয়েছে, একটি সিন্ডিকেটের অফিস দখলকে কেন্দ্র করে এ দিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ শাসক দলের দুই নেতার অনুগামীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ধীরে ধীরে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় গোটা এলাকা। রড-লাঠি নিয়ে দু’পক্ষই একে অন্যের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাতে ১০ জন জখম হয়েছেন। পরে পুলিশ এসে লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। বিধাননগরের এডিসিপি (এয়ারপোর্ট) সন্তোষ নিম্বলকর বলেন, “সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”

রাজারহাট-নিউটাউনে সিন্ডিকেটের দাপট নতুন নয়। তেমনই নতুন নয় সিন্ডিকেটের দখল নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষ। ওই রেষারেষির জেরেই ২০১১ সালে স্বপন মণ্ডল নামে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা খুন হন বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ দিনের সংঘর্ষের ফলে সেই সিন্ডিকেটের দাপটই আরও এক বার সামনে এল বলে অভিযোগ রাজ্যের বিরোধী দলগুলির। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ বলছেন, গত ক’মাসে নিউটাউন-রাজারহাটের নানা এলাকায় এমন বহু গোলমাল হয়েছে। কিন্তু তা আমজনতাকে এ দিনের মতো আতঙ্কিত করে তোলেনি। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে দিনেদুপুরেও রাস্তায় বেরোতে ভয় পাচ্ছেন রামকৃষ্ণপল্লির বাসিন্দারা। রাত পর্যন্ত অবশ্য পুলিশ রয়েছে সেখানে। স্থানীয় একটি আবাসনের বাসিন্দারা বলেন, “গত ক’মাসে ফুটপাথে দোকান বসানো নিয়ে দু’দলে ছোটখাটো ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু এ দিনের ঘটনা সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে।”

Advertisement

নিউটাউনের অ্যাকশন এরিয়া ওয়ানে একাধিক সমবায় আবাসন রয়েছে। আরও বেশ কিছু আবাসন তৈরির কাজ চলছে। এই নির্মাণের কাজে প্রচুর ইমারতি সামগ্রী লাগে এবং সেই সব জিনিস সরবরাহকে সামনে রেখেই বাম আমলে গজিয়ে ওঠে একের পর এক সিন্ডিকেট। ২০১১-তে রাজ্যে ক্ষমতা বদল হলেও ওই এলাকার সিন্ডিকেটগুলির ক্ষমতা এতটুকু তো কমেইনি, উল্টে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। তফাত এটাই, সিন্ডিকেটগুলি যাঁরা চালাতেন, রাজ্যে ক্ষমতা হাতবদলের পরে তাঁরাও শিবির বদলেছেন। সিপিএমের বদলে তৃণমূলের নেতারা এখন সিন্ডিকেটগুলির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন। পুলিশ বলছে, ইমারতি সামগ্রীর বরাত থেকে বেশি মুনাফা আদায়ের জন্য সিন্ডিকেট দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন দুই তৃণমূল নেতার অনুগামীরা। তারই জেরে এ দিনের গোলমাল, মারামারি।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, রাজারহাট-নিউটাউনের যুব তৃণমূল সভাপতি আফতাবউদ্দিন এবং জ্যাংড়া-হাতিয়াড়া ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রধান শিবু গায়েন দু’টি পৃথক সিন্ডিকেট গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেন। দলীয় মহলে আফতাব বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার ও শিবু নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। যে সিন্ডিকেটের দখল নিয়ে এ দিনের লড়াই, সেটি দীর্ঘ দিন শিবুর দখলে ছিল। এলাকায় ইমারতি সামগ্রী সরবরাহের একচেটিয়া ছিল তাঁর হাতেই। লোকসভা ভোটের কিছু দিন আগে থেকে আফতাব ও তাঁর সঙ্গীরা রামকৃষ্ণপল্লি এলাকায় সিন্ডিকেটের দখল নেওয়া শুরু করেন। তখনই এলাকা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ভোটের আগে পুলিশি নজরদারি বেশি থাকায় গোলমাল খুব একটা মাথাচাড়া দিতে পারেনি।

কী ঘটেছে শনিবার?

স্থানীয় লোকজন জানান, এ দিন জনা পঁচিশেক সঙ্গী নিয়ে আফতাব রামকৃষ্ণপল্লির ওই সিন্ডিকেটের অফিসে বসেছিলেন। সে সময় রাস্তার দু’দিক (এক দিকে নিউটাউন থানা ও অন্য দিকে খেলার মাঠ) থেকে দু’দল লোক মোটরসাইকেলে চড়ে নিয়ে হাজির হন। তাঁরা শিবুর অনুগামী বলে বক্তব্য স্থানীয়দের। পুলিশ জানিয়েছে, এর পরে শিবুর লোকজন আফতাবদের অফিস ছেড়ে দিতে বলে। এ নিয়ে দু’পক্ষে বচসা বাধে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু মারামারি, ভাঙচুর। তার মধ্যেই দু’দল লাঠি-রড নিয়ে একে অন্যকে পেটাতে থাকেন। খবর পেয়ে প্রথমে পুলিশ ও পরে র‌্যাফ এসে দু’দলকে ছত্রভঙ্গ করে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সংঘর্ষকারীরা পালানোর চেষ্টা করলে র‌্যাফ পিছু ধাওয়া করে ১২ জনকে গ্রেফতার করে।

যে দু’টি চরিত্র এ দিনের সংঘর্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে পুলিশের অভিযোগ, সেই আফতাবউদ্দিন ও শিবু গায়েন একে অন্যের উপরে দোষ চাপিয়েছেন। আফতাবউদ্দিন বলেছেন, “ভজাই নামে বিরোধী গোষ্ঠীর এক দুষ্কৃতী এলাকা দখল করেছিল। আমাদের কাউকে কাজ করতে দিত না। কিন্তু ভোটের পরে আমাদের ছেলেরা কাজ করতে পারছে।” আফতাবের অভিযোগ অস্বীকার করে তাঁর বিরোধী সিন্ডিকেট গোষ্ঠীর নেতা শিবুর দাবি, “আফতাবের ছেলেরাই গোলমাল পাকিয়েছে। আমাদের ছেলেদের মারধর করেছে।”

কী বলছেন তৃণমূল নেতারা?

নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত বলেন, “কিছু বহিরাগত লোক কোদালের বাঁট ও লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালিয়েছে। পুলিশকে শক্ত হতে বলেছি।” হামলাকারীরা কি তৃণমূল? বিধায়কের জবাব, “কোদালের বাঁট নিয়ে যারা হামলা করে, তাদের আবার রাজনৈতিক পরিচয় কী!” সব্যসাচীবাবুর মতো বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারও মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে বলেছেন, “ব্যক্তিগত স্বার্থে বহিরাগতদের নিয়ে এলাকার সুস্থ পরিবেশকে অশান্ত করার চেষ্টা হচ্ছে।” কারা এই রকম অশান্তি করছে? জবাব দেননি কাকলি। তবে তাঁর বক্তব্য, এই ঘটনার সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই।

রাজারহাট-নিউটাউনে সিন্ডিকেট-দ্বন্দ্বে নেতাদের নাম জড়ানো নতুন নয়। সিন্ডিকেটের দখল নিয়ে বছর তিনেক আগে স্বপন মণ্ডল নামে এক তৃণমূল নেতাকে যেখানে খুন করা হয়েছিল, সেটি শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর বিধানসভা এলাকা। তিনি বলেছেন “নিউটাউন আমার নির্বাচনী কেন্দ্রের বাইরে। ফলে ওখানে কী ঘটেছে, জানি না। জানার কথাও নয়।”

তৃণমূলের একাংশ বলছেন, রাজারহাট-নিউটাউনে সিন্ডিকেটের দখল নিয়ে মারামারি আসলে সব্যসাচীবাবু ও কাকলীদেবীর মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধেরই জের। লোকসভা ভোটের আগে সেই বিরোধ চরমে পৌঁছয়। অভিযোগ, কাকলিদেবীর ভোটের প্রচারে সব্যসাচীবাবুর অনুগামীরা সে ভাবে সক্রিয় হননি। সেই সুযোগে কাকলিদেবীর অনুগামীরা সব্যসাচীবাবুর বিধানসভা কেন্দ্রের অধীন রাজারহাটের যাত্রাগাছি ও ঘূর্ণি এলাকা নিজেদের দখলে নেয়। অভিযোগ, ইমারতি সামগ্রীর সরবরাহের বরাত হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া রুখতেই ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে সব্যসাচীবাবুর অনুগামীরা। তাই এলাকা পুনদর্খলে নেমেছেন তাঁরা। এ দিনের গোলমালও সেই সূত্রে বলেই দাবি তৃণমূলের ওই অংশের। তৃণমূল সূত্রের খবর, এ দিনের ঘটনায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ক্ষুব্ধ। জেলা নেতৃত্বের কাছ থেকে এ ব্যাপারে রিপোর্ট চেয়েছেন তাঁরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement