সেন্ট জনস গির্জার সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিচ্ছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই)। প্রায় ১৫ মাস আগে শহরের ঐতিহ্যপূর্ণ ২৩০ বছরের পুরনো এই গির্জা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য সরকার। বরাদ্দ হয় ৪ কোটি টাকা। দফায় দফায় সমীক্ষার পর শুরু হয় সাফসুতরো, ছোটখাটো মেরামতি। কিন্তু আইনি বাধায় সংস্কারের কাজ আটকে যাওয়ার পরে এখন এএসআই-ই ওই কাজে হাত দিচ্ছে।
রাজভবনের উত্তর-পশ্চিম কোণে শোভাবাজারের রাজপরিবারের দান করা জমিতে ১৭৮৪-র ৬ এপ্রিল তৈরি হয় বিশাল এই গির্জাটি। শিলান্যাস করেন লাটসাহেব ওয়ারেন হেস্টিংস। লন্ডনের সেন্ট মাফিন-ইন-দি-ফিল্ডের আদলে গড়া অনুপম এই গির্জাচত্বরে রয়েছে জোব চার্নকের সৌধ এবং লেডি ক্যানিংয়ের প্রায় ১২ ফুট উঁচু, ১০ ফুট চওড়া, ২০ ফুট লম্বা শ্বেতপাথরের সমাধিবেদী। আছে আরও বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির সমাধিও।
বিশাল এই গির্জার চূড়া তৈরি হয়েছিল মালদহের গৌড় থেকে আনা পাথরের টালি বসিয়ে। কিছু অংশে সে সব খুলে গিয়েছে। ছাদের কিছু অংশ চুঁয়ে জল পড়ে। এ সব মেরামতির পাশাপাশি গির্জার ঘণ্টার নাগাল পেতে মূল আদলের সিঁড়ি, তিনটি ফোয়ারা, নিকাশি, আলোকসজ্জা তৈরি, নতুন করে রং লাগাতে গির্জার বাইরের আস্তরণ ঘষে মূল রং বার করা, মেক্সিকো থেকে আনা ঘাস লাগানো সংস্কারের এমন একগুচ্ছ পরিকল্পনা নেয় রাজ্য। প্রকল্প রূপায়ণের লক্ষ্যে তৈরি হয় সাত সদস্যের কমিটি। এর অন্যতম সদস্য, পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ার কনকেন্দু সিংহ গত বছর অগস্ট মাসে বলেছিলেন, “ছ’টি পর্যায়ে হবে সংস্কারের কাজ। সময় লাগবে বছরখানেক।” রাজ্য পর্যটন দফতর এই প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্ব দিয়েছিল পূর্ত দফতরকে।
কিন্তু প্রাথমিক পর্বের ছোটখাটো মেরামতি শুরুর পরেই কাজ বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কেন? রাজ্যের পর্যটন-অধিকর্তা তথা দফতরের যুগ্ম সচিব উমাপদ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “প্রকল্প রূপায়ণে আমরা সত্যিই আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু এএসআই-এর চূড়ান্ত অনুমতি পেলাম না।”
এএসআই-এর অনুমতি কেন মিলল না? সংস্থার এক পদস্থ আধিকারিক বলেন, “১৯৫৮ সালের প্রত্নতাত্বিক দ্রষ্টব্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এই তালিকাভুক্ত ভবনগুলো সংরক্ষণ ও মেরামতির দায়িত্ব কেবল এএসআই-এর। আমরা তাই পর্যটন দফতরকে অনুমতি দিতে পারিনি।” কাজ কবে থেকে শুরু হবে? এএসআই-এর ওই কর্তা বলেন, “সংস্কারের কাজ শুরুর আগে ওঁদের সঙ্গে আমাদের লিখিত একটি সমঝোতাপত্র হবে।”
গির্জা সংরক্ষণের পূর্ত দফতরের প্রাথমিক কাজে আপত্তি জানান এএসআই-এর আঞ্চলিক অধিকর্তা তপনজ্যোতি বৈদ্য। পূর্ত দফতরের আগে তাঁরাই কেন এই গির্জা সংরক্ষণে উদ্যোগী হননি? তপনবাবুর বক্তব্য, “বছর সাতেক আগে ওই গির্জার একাংশে কর্তৃপক্ষ একটা নির্মাণের চেষ্টায় কিছু মেরামতি করান। আমরা বাধা দিই। দু’তরফে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়। আমরা সংস্কারের প্রস্তাব দিই। কিন্তু সে সময়ে গির্জা-কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাইনি। ১৮৫৬ সালের আইনটি ১৯১০ সালে পরিমার্জন হয়। তাতে বলা হয়েছে, এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী ভবনের সংস্কার ও সংরক্ষণ কেবল এএসআই-ই করবে।”
সেন্ট জন্স গির্জার তরফে ‘ক্যালকাটা ডায়োসেশন ট্রাস্ট’-এর অবৈতনিক কোষাধ্যক্ষ রীতেশ সরকার বলেন, “রাজ্য না কেন্দ্র সংস্কারের কাজ কে করবে, তা নিয়ে আমাদের পছন্দের ব্যাপার নেই। এএসআই যেহেতু আইনি দাবির কথা তুলছেন, ওঁদের প্রাথমিক সমীক্ষার অনুমতি দিয়েছি।” রেভারেন্ড প্রদীপ নন্দা বলেন, “গির্জার তত্ত্বাবধানেই হবে সংরক্ষণের কাজ।”
গির্জার প্রায় ৪০টি দুষ্প্রাপ্য ছবি দেখিয়ে প্রদীপবাবু বলেন, “আমাদের অনুরোধে ‘ইনটাক’-এর বিশেষজ্ঞেরা এগুলো সংরক্ষণ করেছেন।” গির্জার দুষ্প্রাপ্য ছবির তালিকায় রয়েছে ব্রিটিশ শিল্পী যোহান জেফানির তৈলচিত্র, দ্য ভিঞ্চির ‘লাস্ট সাপার’-এর অনুকরণ। ১৭৮৩ সালে দ্বারোদ্ঘাটনের সময়ে গির্জা-কর্তৃপক্ষকে জেফানি এটি উপহার দেন। ওঁর এ রকম আঁকা আর একটিই আছে, লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। গির্জার প্রাচীন অর্গানটির রক্ষণাবেক্ষণেই ফি বছর খরচ হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা। এ কথা জানিয়ে প্রদীপ নন্দা বলেন, “এ রকম অর্গান এখন হাতে গোনা। গির্জার ঘড়িঘরের সিঁড়ি ভেঙে যাওয়ায় বেশ কিছুকাল প্রাচীন ঘড়িটিতে দম দেওয়া যাচ্ছিল না। এখন ওখানে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।”