শিয়ালদহ স্টেশনে অরক্ষিত প্রবেশপথ।
সকাল সাড়ে ৯টা। হাওড়া স্টেশনের পাঁচ নম্বর গেটের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন দুই যুবক। হাতে ব্যাগ। লাগেজ স্ক্যানারের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পরে হনহন করে এগিয়ে গেলেন প্ল্যাটফর্মের দিকে। এক যুবক বললেন, “ভাবলাম মেশিনে ব্যাগ দেখবে। এখানে তো দেখছি এ সবের বালাই নেই।” ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক নিরাপত্তাকর্মী। কার্যত নিধিরাম সর্দারের মতো।
একই চিত্র শিয়ালদহেও। সকাল ১০টা। এক থেকে পাঁচ, পরপর প্রতিটি প্ল্যাটফর্মেই ১০ মিনিটের ব্যবধানে দাঁড়াল ট্রেন। দু’-এক মিনিটের মধ্যেই শিয়ালদহের ওই প্ল্যাটফর্মগুলিতে আর দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। হাজার হাজার যাত্রী ছুটে বেরিয়ে আসছেন প্ল্যাটফর্ম থেকে। কারও মাথায় ঝুড়ি, কারও বা দু’হাতেই ছোট-বড় ব্যাগ। কেউ ঠেলায় চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বস্তা। কিন্তু তাতে কি কোনও বিস্ফোরক আছে? দেখবে কে? কোথায় পুলিশ?
কিন্তু জঙ্গি আক্রমণের খবরে উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর বুধবার থেকে দেশ জুড়ে সব জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিতে বিশেষ নজরদারির নির্দেশ দিয়েছে। তার পরেও নিরাপত্তার তেমন কোনও পরিবর্তন চোখে পড়েনি এখানে। কেন এই অবস্থা?
আসলে সেই ‘ট্র্যাডিশন’ সমানেই চলেছে। ভোর থেকে রাত। হাওড়া ও শিয়ালদহে এক এক করে ঢুকছে-বেরোচ্ছে ট্রেন। আর কাতারে কাতারে মানুষের ঢল ছুটে যাচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। কে আটকাবে কাকে! এ নিয়ে কারও মাথাব্যথাই নেই। থাকলেও লাভ নেই, এমনটাই বক্তব্য পুলিশকর্মীদের। তাঁদের কথায়, প্রতিদিন দুই স্টেশন মিলিয়ে নয় নয় করে ৩০ লক্ষ যাত্রী যাওয়া-আসা করছেন। এত লোক সামলাতে যে পরিকাঠামো এবং যত পুলিশকর্মী প্রয়োজন, তা এখানে নেই। ফলে এখানে নিরাপত্তা দেওয়া আর সাগরে ঝিনুক খোঁজা একই।
হাওড়া স্টেশনের পুরনো কমপ্লেক্সে ১৩টি গেট। ভোর থেকেই হাজারো যাত্রী ঢুকছেন-বেরোচ্ছেন। ভিড়ে ঠাসা প্ল্যাটফর্মে লাঠি হাতে ঘুরতে দেখা গেল দু’-তিন জন বয়স্ক রেলরক্ষী জওয়ানকে। তাঁদেরই এক জন বললেন, “কয়েক দিন হল আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র তুলে নিয়ে আমাদের হাতে লাঠি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এখন অন্য অস্ত্রের দরকার নেই।” কিন্তু শুধু লাঠিতে হাওড়া স্টেশনের নিরাপত্তা সামলানো সম্ভব? অধিকাংশ রেলরক্ষী জওয়ানই বলছেন, সম্ভব নয়। আচমকা জঙ্গিরা হামলা করলে তা মোকাবিলার মতো অস্ত্রই নেই তাঁদের।
কেমন নিরাপত্তা দরকার? প্রতিটি গেটে পুলিশকর্মী মোতায়েন, সন্দেহ হলে যাত্রীদের মালপত্র পরীক্ষা করা, সিসিটিভি-তে নজরদারি চালানো, ট্রেনগুলিতে কুকুর নিয়ে তল্লাশি এবং যাত্রীদের ঘোষণার মাধ্যমে সচেতন করা। প্রয়োজন সবেরই। কিন্তু তার অধিকাংশের ব্যবস্থাই নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশকর্মী বলেন, “আমরা লোক দেখে বুঝতে পারি। এত যাত্রী পরীক্ষা করলে অনেক সময় লেগে যাবে।” এই যাত্রীদের মধ্যে যদি কেউ নাশকতার উদ্দেশে বিস্ফোরক নিয়ে ঢোকেন, তা হলে কতটা তৈরি পুলিশ? শিয়ালদহের এসআরপি উত্পল নস্কর বলেন, “ডোর ফ্রেম মেটাল ডিটেক্টর এখন উঠে গিয়েছে। আমরা সিসিটিভি দিয়ে নজরদারি চালাচ্ছি। সন্দেহ হলে তল্লাশি করা হচ্ছে।” স্টেশনগুলিতে আইন-শৃঙ্খলার মূল দায়িত্ব রাজ্যের। কিন্তু রেলেরও কিছুটা দায়িত্ব আছে। রেল ওই দায়িত্ব সামলায় আরপিএফ মোতায়েন করে। রেলের কর্তারা জানিয়েছেন, দিল্লির ওই নির্দেশের পরে জিআরপি এবং আরপিএফ-কেও রেলের তরফে চূড়ান্ত সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রহরা আরও বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে। গেটে কী ভাবে মেটাল ডিটেক্টর বসানো যায়, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সারানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে অকেজো হয়ে পড়ে থাকা লাগেজ স্ক্যানারগুলিকে।
মেট্রো-চিত্র
সকাল সাড়ে ৮টা। মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশনের গেটে স্ক্যানার অকেজো। পাশেই টেবিল পেতে গল্পে মত্ত পুলিশ ও রেলরক্ষী বাহিনীর চার কর্মী। একের পর এক যাত্রী সামনে দিয়ে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছেন। হেলদোল নেই কারও। মাঝেমধ্যে কোনও যাত্রীকে ডেকে নামমাত্র ব্যাগে হাত বুলিয়ে বা মেটাল ডিটেক্টর ঠেকিয়ে দায় সেরে নেওয়া। ব্যস।
নোয়াপাড়া থেকে কবি সুভাষ— ২৪টি মেট্রো স্টেশনের সুরক্ষার ছবিটা এ রকমই। সব স্টেশনের সব ক’টি প্রবেশপথে মেটাল ডিটেক্টর গেট নেই। নেই লাগেজ স্ক্যানারও। যেখানে দু’টি ব্যবস্থাই রয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার অবস্থা লোক-দেখানো। কয়েকটি স্টেশনে নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে মেটাল ডিটেক্টর থাকলেও ব্যবহার হচ্ছে মর্জিমাফিক। নজরদারির বদলে রক্ষীদের খোশগল্পে কিংবা মোবাইলে মজে থাকা তো আছেই। তাই নিরাপত্তা বলয়ের সামনে কোনও রকম পরীক্ষায় না পড়েই উতরে যাচ্ছেন যাত্রীরা।
ঢিলেঢালা নজরদারির সেই ছবিই ধরা পড়ল বৃহস্পতিবার দিনভর।
সকাল সাড়ে ৯টা। কবি সুভাষ স্টেশনে যাত্রীদের চাপ রয়েছে। তবে নিরাপত্তা বলয়ের চিহ্নমাত্র নেই। প্ল্যাটফর্মে ওঠার গেটের মুখে উর্দি পরা কয়েক জন ঘোরাঘুরি করছেন বটে, তবে কাউকেই পরীক্ষা করছেন না।
সকাল ১০টা। কবি নজরুল স্টেশনে ট্রেন ধরার হুড়োহুড়ি চলছে। মেটাল ডিটেক্টর গেট দিয়ে ঢোকার বালাই নেই। যাত্রীরা যে যার মতো ছুটছেন। রক্ষীরা দর্শক।
সকাল ১১টা। ব্যস্ত রবীন্দ্র সদন স্টেশনের দু’টি প্রবেশপথ দিয়ে অসংখ্য যাত্রী প্ল্যাটফর্মে ওঠা-নামা করছেন। মেটাল ডিটেক্টর গেট থাকলেও তার ভিতর দিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। নন্দনের দিকের প্রবেশপথে স্ক্যানার রয়েছে বটে। তবে যাত্রীরা ইচ্ছে হলে তাতে ব্যাগ দিচ্ছেন, না হলে গটগটিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছেন। একই ছবি ছিল পার্ক স্ট্রিটেও।
বেলা সাড়ে ১১টা। ধর্মতলা স্টেশনের মাঝের প্রবেশপথে স্ক্যানার রয়েছে। রয়েছে মেটাল ডিটেক্টর গেটও। যাত্রীরা কেউ কেউ স্বেচ্ছায় স্ক্যানারে ব্যাগ দিচ্ছেন। কিন্তু স্ক্রিনের ছবিতে নজর রাখার ভার যাঁর উপরে, সেই মহিলা রেলরক্ষী এক পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে ব্যস্ত। ফলে পরীক্ষা ছাড়া বিনা বাধাতেই দিব্যি প্ল্যাটফর্মে ঢুকছেন যাত্রীরা।
বিকেল ৪টে। নোয়াপাড়া স্টেশন খাঁ খাঁ করছে। ট্রেন কম থাকায় যাত্রী কম। দেখা নেই নিরাপত্তারক্ষীদেরও। প্রায় ফাঁকা স্টেশনে যে যার খুশি মতো চলাফেরা করছেন।
বিকেল সওয়া ৪টে। দমদম স্টেশনে যাত্রীদের ভিড়। পরীক্ষা করার অবশ্য কেউ নেই। একটি গেটে স্ক্যানার থাকলেও তা বিকল। এক দিকের মেটাল ডিটেক্টর গেট সরানো রয়েছে অন্যত্র। বাকি গেটের নিরাপত্তা রক্ষীরা কার্যত খোশগল্পে ব্যস্ত।
বিকেল ৫টা। শোভাবাজার-সুতানুটিতেও লাগেজ স্ক্যানার ‘আউট অব অর্ডার।” যাত্রীদের ব্যাগ পরীক্ষা করার কোনও ছবিই এ দিন সেখানে চোখে পড়েনি।
ব্যতিক্রম শুধু সকাল সাড়ে ১০টার কালীঘাট স্টেশন। স্ক্যানারে ব্যাগ পরীক্ষা করানোর পরে মেটাল ডিটেক্টর পেরিয়ে তবেই মিলেছে স্মার্ট গেটে পৌঁছনোর ছাড়পত্র।
বৃহস্পতিবার ছবিগুলি তুলেছেন বিশ্বনাথ বণিক ও দীপঙ্কর মজুমদার।