অলঙ্করণ: প্রবাল ধর
আয় ২০ কোটি। ব্যয় ৩০ কোটি। রোজকার ফারাকটা ১০ কোটি। আর, এই ফারাক দিন দিন বাড়তে থাকায় শঙ্কা বাড়ছে পরিবেশবিদদের।
হিসেবটা কোনও সংস্থার আর্থিক আয়-ব্যয়ের নয়। কলকাতার ভূগর্ভে জল জমা এবং জল নিষ্কাশনের হিসেব এটি। কেন্দ্রীয় ভূ-জল পর্ষদের রিপোর্ট বলছে, কলকাতায় প্রতিদিন গড়ে ২০ কোটি ৪০ লক্ষ লিটার জল জমা হয় ভূগর্ভে। কিন্তু তোলা হয় দৈনিক ৩০ কোটি পাঁচ লক্ষ লিটারের কিছু বেশি। সাধারণ মানুষ, পুরসভা কিংবা বিভিন্ন শিল্প সংস্থা কেউই যথেষ্ট সচেতন না-হওয়ায় বছর বছর আয় ও ব্যয়ের ফারাক বাড়ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ভূ-জল পর্ষদের সমীক্ষকেরা। তাঁদের আশঙ্কা, আগামী ১০-১৫ বছরে এই ফারাক ৩০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। তীব্র জলসঙ্কটে পড়বে শহর।
পর্ষদের একটি সমীক্ষা-রিপোর্ট জানাচ্ছে, ১৯৫৮ সালের তুলনায় কলকাতায় ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর নেমে গিয়েছে প্রায় ১৪ মিটার।
পর্ষদের গবেষকেরা জানান, ভূগর্ভে বিভিন্ন গভীরতায় বিভিন্ন জলস্তর আছে। ভূ-গর্ভস্থ জলভাণ্ডারের মধ্যস্থলে বছরে গড়ে ০.৪৯ মিটার করে জলস্তর নামছে। ভাণ্ডারের ধারের দিকের গভীরতায় বার্ষিক জলস্তর নামার হার ০.২১ মিটার। আর, এই জলস্তর নামার জন্য ভূ-জল পর্ষদের গবেষকেরা মূলত দায়ী করেছেন গত কয়েক বছরে কলকাতায় মাথাচাড়া দেওয়া কংক্রিটের জঙ্গলকে। পর্ষদের হিসেব অনুয়ায়ী, ১৯৯৯ সাল থেকে কলকাতায় হঠাৎ করে ভূগর্ভস্থ জলের উপরে অত্যধিক চাপ পড়তে শুরু করে। তখন থেকেই মহানগরীতে বহুতল বিপ্লবের শুরু বলে কেন্দ্রীয় ভূ-জল পর্ষদের এক গবেষক জানান।
পর্ষদের বক্তব্য, মূলত তাদের সুপারিশেই ২০০৫ সালে রাজ্যের তৎকালীন সরকার ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আইন চালু করে। কিন্তু ওই আইন কলকাতা পুর এলাকায় চালু করা হয়নি। পর্ষদের গবেষকদের মতে, কলকাতা পুর এলাকায় তখনই এই আইন কার্যকর করা উচিত ছিল। কলকাতা পুরসভার অবশ্য ব্যাখ্যা, ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পুরসভার বিল্ডিং আইনে পরিবর্তন করা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করা যাবে না, এই শর্তেই এখন বাড়ির নকশা অনুমোদন করা হয়।
শুধু তাই নয়। বহুতল তৈরির সময়ে যে জল প্রয়োজন হয়, তার অনুমোদন দিতে পুরসভা এবং রাজ্য জল অনুসন্ধান ডিরেক্টরেটকে (স্যুইড) নিয়ে একটি রাজ্যস্তরের কমিটি আছে। বহুতল তৈরির পরে আবাসিকদের জল সরবরাহের অনুমতিও দেয় এই কমিটি। তার জন্য বহুতল তৈরির নকশায় জলের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করতে হয়। কমিটির এক সদস্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান আশিস মজুমদার বলেন, “বাড়ি তৈরির সময়ে কুয়ো খোঁড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু বাড়ি তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে ওই কুয়ো বন্ধ করে দেওয়ার নিয়ম।” কিন্তু তা বন্ধ করা হল কি না, তা দেখার মতো লোকবল পুরসভার নেই। ফলে ওই সব গভীর কুয়োর একটাও আদৌ বন্ধ করা হয়েছে কি না, সে খবরও পুর-কর্তৃপক্ষের কাছে নেই।
ভূ-জল পর্ষদের আঞ্চলিক অধিকর্তা গৌরাঙ্গচরণ পতি বলেন, “যে হারে কলকাতায় বহুতল তৈরি বেড়েছে, তার সঙ্গে পুরসভার নজরদারি বাড়েনি। ফলে মাটির তলার জলের সঞ্চয়ও কমে আসছে।” কলকাতা পুর এলাকার ১৪১টি ওয়ার্ডের ১৮৭.৩৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বছরে গড় বৃষ্টির পরিমাণ ১ হাজার ৬৪৭ মিলিমিটার। তার কতটা ভূগর্ভে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রকল্প কলকাতায় রয়েছে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কেন্দ্রীয় ভূ-জল পর্ষদের গবেষকদের অনেকেই।
কলকাতা পুরসভার জল বিভাগের অধিকর্তা বিভাস মাইতির বক্তব্য, “বিশেষত দক্ষিণ ও পূর্ব কলকাতার প্রত্যন্ত এলাকায় শুধু গার্ডেনরিচের জল দিয়ে প্রয়োজন মেটানো যাচ্ছে না। তাই ভূগর্ভের জল তোলার অনুমতি দিতেই হয়।” ওই পুর-আধিকারিকের বক্তব্য, বহুতলের অনুমোদন পেতে ভূগর্ভে বৃষ্টির জল ফিরিয়ে দেওয়ার (রেন ওয়াটার হার্ভেস্টিং) প্রকল্প কার্যকর করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ওই শর্ত কাগজে-কলমেই রয়ে গিয়েছে, বলছেন ভূ-জল পর্ষদের গবেষকেরা।
ওই গবেষকেরা জানান, কেন্দ্রীয় পর্ষদের ব্যবস্থাপনায় তাঁদের কলকাতার দফতর, রাজভবন-সহ কয়েকটি বাড়ির ছাদে জল ধরে ভূগর্ভে প্রবেশ করার ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু যে ভাবে শহরের ভূগর্ভে জল সংরক্ষণ ও নিষ্কাশনের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, তাতে রাজ্য সরকার এবং পুর-কর্তৃপক্ষের আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, মনে করছেন কেন্দ্রীয় পর্ষদের গবেষকেরা।