বিধি ভেঙে এ ভাবেই পারাপার। ডালহৌসি চত্বরে। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
দৃশ্য ১: ডালহৌসির মোড়। সিগন্যাল সবুজ থাকায় মহাকরণের দিক থেকে ধর্মতলার দিকে বেশ গতি বাড়িয়েই ছুটে আসছে বাস, ট্যাক্সি। এরই মাঝে রাস্তা পার হওয়ার সিগন্যাল লাল থাকলেও কার্যত তাকে তোয়াক্কা না করেই দলে দলে পথচারীরা প্রায় সকলেই হাত দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। তখনই জোড়ে ব্রেক কষে বিকট আওয়াজে দাঁড়িয়ে পড়ছে একের পর এক গাড়ি। এর জেরে যেমন বাড়ছে যানজট, তেমনই বাড়ছে দুর্ঘটনার ঘটে যাওয়ার আশঙ্কাও।
দৃশ্য ২: ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদ মোড়। যে যেমন খুশি রাস্তা পার হচ্ছেন। সেই অবস্থায় এক ব্যক্তির পায়ে ট্যাক্সির সামনের অংশের ছোঁয়া লাগতেই রেগে চালকের দিকে তেড়েও গেলেন তিনি। অন্যেরা কোনও রকমে তাঁকে শান্ত করলেন। ট্রাফিক নিয়ম ভাঙার পরেও কোনও জরিমানা তো তাঁর হলই না। উল্টে চালককে কয়েকটি কথা শুনিয়ে যেন বুঝিয়ে দিলেন কলকাতার রাস্তায় এ ভাবেই পার হওয়াটা নিয়ম।
যদিও আইন বলছে অন্য কথা।
কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে খবর, ২০০৩ ও ২০০৮ সালে রাজ্য সরকারের তরফে পথচারীদের জন্য জেব্রা ক্রসিং ও সিগন্যাল মানার নির্দেশিকা জারি হয়েছে। যার নাম ‘জে ওয়াকিং।’ কলকাতা পুলিশের ট্রাফিকের আইন বিভাগ সূত্রে খবর, দু’টি নিয়ম স্পষ্টত উল্লেখ রয়েছে এই নির্দেশিকায়। প্রথমত, কলকাতার রাস্তা পার হওয়ার জন্য পথচারীদের জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার বাধ্যতামূলক। দ্বিতীয়ত, সিগন্যাল লাল থাকা সত্ত্বেও হাত দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার হওয়াটা জরিমানাযোগ্য অপরাধ। এক ট্রাফিক পুলিশ কর্তা জানান, নিয়ম ভাঙলে পথচারীদের দু’ভাবে জরিমানা করা হয়। প্রথমত ‘স্পট ফাইন’। অর্থাৎ দু’টি নিয়মের কোনও একটি না মানলেই পুলিশ ওই পথচারীকে হাতেনাতে ধরে ৫০ টাকা জরিমানা করতে পারে। সে সময় ওই পথচারীর কাছে জরিমানা দেওয়ার টাকা না থাকলে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতারও করতে পারে। শেষে তাঁকে আদালতে তোলা হলে বিচারক জরিমানা ধার্য করেন। সেই টাকা না দিতে পারলে ঠিকানা সোজা শ্রীঘর।
ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে খবর,২০১২ সালে এ রকম কেসের সংখ্যা ছিল ৬৩০০৪টি। যেখান থেকে পুলিশের আয় হয়েছে প্রায় ৬ লক্ষ ৪৮ হাজার ৯০৭ টাকা। আবার ২০১৩ সালে সেই সংখ্যা হয়েছে ৩৭১৩০ টি। আদায়ীকৃত অর্থ ৩ লক্ষ ৮ হাজার ৮৬৫ টাকা। অর্থাৎ আপেক্ষিক ভাবে শহরে এই প্রবণতা কমেছে বলেই মনে হয়। কিন্তু সেই ধারণা একেবারেই ঠিক নয় বলেই মত পুলিশের।
এক পুলিশ কর্তা জানান, দড়ি ছাড়া ট্রাফিক পুলিশের কাজ করাই এক প্রকার অসম্ভব। তিনি জানান, পার্ক স্ট্রিট হোক বা ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদের মোড়, সর্বত্রই পথচারীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য দড়ি বাবহার করতে হয়। হেঁটে রাস্তা পার হওয়ার সিগন্যাল লাল হওয়া মাত্রই গাড়ি চলতে শুরু করে। কিন্তু সেটিকে যাতে সাধারণ মানুষ উপেক্ষা করতে না পারেন, তাই দড়ি ধরে রাস্তার ধারে দু’প্রান্তে দুজন ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে পড়েন। ফলে যাত্রীরা আর রাস্তা পার হতে পারেন না। কিন্তু এখানেও বেশ বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন পুলিশেরা। তাঁরা জানান, “কেউ কেউ দড়ির নীচ দিয়েই রাস্তা পার হয়।” অর্থাৎ পুলিশ দড়ি ধরেও যে পথচারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, এটাই তার সব থেকে বড় প্রমাণ। তবে পুলিশের একাংশের অবশ্য মত, পুলিশ দড়ি ধরার কাজ করে বলে দুর্ঘটনা অনেকটাই এড়ানো গিয়েছে।
কিন্তু এই নিয়ম ভাঙার খেলা গোটা ট্রাফিক ব্যবস্থার উপরেই প্রভাব ফেলে বলে জানিয়েছেন ট্রাফিক বিভাগের এক কর্তা। তিনি জানান, সিগন্যাল চালু থাকা সত্ত্বেও যে ভাবে বহু মানুষ রাস্তা পার হন তার ফলে গাড়ির গতি কম করতে হয়। ফলে পাঁচ মিনিটে যে সংখ্যক গাড়ি চলে যেতে পারত, তা আর হয় না। সেই জট ছড়িয়ে পড়ে তার পরের ক্রসিংগুলিতেও। এ ভাবে পরপর ক্রসিংয়ের জট গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। যানজট যেটুকু হোক না কেন, তার জন্য পথচারীদের এই সিগন্যাল না মানার কারণটাই বেশি পরিমাণে দায়ী। তাই এই অবস্থা ঠিক না হলে ট্রাফিকের এই সমস্যা মিটবে না বলেই মত দিয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের একাংশ।
কুঁদঘাটের এক বাসিন্দা সুদীপ দায় বলেন, “আগে রাস্তা পার হওয়ার সময় দেখতাম আমি একাই দাঁড়িয়ে আছি। আর সবাই অবলীলায় গাড়িকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে পার হয়ে যাচ্ছেন। তার পর থেকে আমিও এ ভাবে পার হই।” অন্য এক পথচারীর দাবি, “এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশের উচিৎ আরও বেশি করে প্রচার চালানো এবং আইন ভাঙা হলে তার জরিমানা করা।”
এ বিষয়ে কলকাতা পুলিশের ডিসি ট্রাফিক দিলীপ আদক বলেন, “এই পরিস্থিতিতে একা শুধু পুলিশ সচেতন হলে চলবে না। জনসাধারণের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যম ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারও সাহায্য প্রয়োজন।” এ ছাড়াও জন সচেতনতার প্রচার আরও বেশি করে চালানো হবে বলে জানান তিনি।