পুলিশি অভিযানে ঢিলেমি, মহানগরে অটো-রাজ চলছেই

সোমবার সকাল পৌনে দশটা। নাগেরবাজার থেকে দমদম যাওয়ার অটো-রুটের মাঝপথে অসংখ্য অফিসযাত্রী দাঁড়িয়ে। অটোস্ট্যান্ডে অন্তত ৬০-৭০ জনের লাইন। কিন্তু রুটের বেশ কিছু অটো স্ট্যান্ডে না এসে মাঝপথেই মুখ ঘুরিয়ে ছুটছে দমদমের দিকে। আর সেই অটো ধরার জন্যই পুরুষ-মহিলা সব যাত্রীদের হুড়োহুড়ি।

Advertisement

অত্রি মিত্র

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৪ ০০:২৫
Share:

সোমবার সকাল পৌনে দশটা। নাগেরবাজার থেকে দমদম যাওয়ার অটো-রুটের মাঝপথে অসংখ্য অফিসযাত্রী দাঁড়িয়ে। অটোস্ট্যান্ডে অন্তত ৬০-৭০ জনের লাইন। কিন্তু রুটের বেশ কিছু অটো স্ট্যান্ডে না এসে মাঝপথেই মুখ ঘুরিয়ে ছুটছে দমদমের দিকে। আর সেই অটো ধরার জন্যই পুরুষ-মহিলা সব যাত্রীদের হুড়োহুড়ি। কোনও চালক অপেক্ষারত যাত্রীদের সামনে এসে অটোর গতি কিছুটা কমিয়ে ফের যাত্রী না নিয়েই চলে যাচ্ছেন। কারও আবদার সবাইকেই খুচরোয় ভাড়া দিতে হবে।

Advertisement

রাত পৌনে আটটা। গড়িয়াহাট মোড় থেকে গড়িয়ায় বাড়ি ফিরবেন বলে অটোর অপেক্ষায় ছিলেন ষাটোর্ধ্ব সোমনাথ রায়। গড়িয়াহাটে অটোর লাইনে প্রায় ৪০ জনের পিছনে আধ ঘণ্টার উপরে দাঁড়িয়ে থেকেও অটো পেলেন না। গড়িয়া থেকে অটোচালকেরা স্ট্যান্ডে এসে যাত্রী নামিয়ে চলে যাচ্ছেন যাত্রীদের না তুলেই। কেউ কেউ আবার অটো দাঁড় করিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন, অন্তত আধ ঘণ্টা পরে গাড়ি ছাড়বেন। অগত্যা হেঁটেই গোলপার্ক মোড়ে গেলেন সোমনাথবাবু। কিন্তু সেখানে গিয়েও কোনও সুরাহা হল না। বেশির ভাগ অটোই যাবে যাদবপুর পর্যন্ত। শেষমেশ একটি অটোয় যাদবপুর পর্যন্ত এসে ফের সেখান থেকে অটো করে প্রায় সাড়ে ন’টা নাগাদ গলদঘর্ম হয়ে গড়িয়া পৌঁছলেন সোমনাথবাবু।

উত্তর থেকে দক্ষিণ মহানগরের অটো-চিত্রটা এ রকমই। অটো-শাসনে নেমে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র ঘোষণা করেছিলেন, ‘কাটা-রুটে’ কোনও অটো চললে পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু ডানলপ থেকে বালি খাল, শোভাবাজার থেকে উল্টোডাঙা, গড়িয়া থেকে গড়িয়াহাট কিংবা রুবি মোড় থেকে রাসবিহারী সর্বত্রই ‘কাটা-রুটে’ যাত্রীদের যেতে বাধ্য করছেন অটোচালকেরা। প্রতিবাদ করেও লাভ হচ্ছে না।

Advertisement

শুধু কাটা-রুটই নয়। লাগামছাড়া অটোর দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে কমিটির পর কমিটি তৈরি হয়েছে। ভুরি-ভুরি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। কিন্তু কলকাতায় অটোর দাদাগিরি রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই।

চলতি বছরের শুরুতে পরপর কয়েকটি ঘটনায় অটোর দৌরাত্ম্যের চিত্র ফের সামনে আসে। বেপরোয়া অটোর ধাক্কায় মৃত্যু হয় দুই বৃদ্ধের। তারাতলায় খুচরো দিতে না পারায় এক মহিলাকে চড় মারেন অটোচালক। পার্ক সার্কাসে বেশি ভাড়া না দেওয়ায় এক মহিলার মাথায় রড দিয়ে মারেন আর এক অটোচালক। পরপর এই সব ঘটনার পরে পুলিশি অভিযানের কথা ঘোষণা করেন মন্ত্রী। নিজেই পথে নেমে অটোচালকদের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু মাস ঘুরতে না ঘুরতেই অটো-দৌরাত্ম্য আগের চেহারায়।

তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে পরিবহণ দফতরের তদানীন্তন যুগ্মসচিব আশিস ঠাকুরের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন পরিবহণমন্ত্রী। অটোকে নিয়ন্ত্রণে আনাই ছিল ওই কমিটির লক্ষ্য। তিন মাসের মধ্যেই ওই কমিটি রিপোর্ট জমা দেয়। কিন্তু এখনও ওই রিপোর্ট দিনের আলো দেখেনি। চলতি বছরের শুরুতে পরপর অটো-দৌরাত্ম্যের ঘটনা সামনে আসার পরে ফের পরিবহণসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কলকাতা পুলিশের বিশেষ কমিশনার (দুই) সৌমেন মিত্রকে নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করা হয়। ওই কমিটিও বেশ কয়েকটি সুপারিশ করে রাজ্য সরকারকে। পরিবহণমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, দ্রুত ওই সব সুপারিশ চালু করবে সরকার।

তার পরে এক মাস কেটে গিয়েছে। বেশির ভাগ সুপারিশই কার্যকর হয়নি। ওই কমিটির সুপারিশ ছিল, প্রতি অটোচালককে নেভি-ব্লু রঙের জামা-প্যান্ট পরতে হবে। অটোচালকের জামার পকেটে তাঁর নাম এবং লাইসেন্স নম্বর লেখা থাকবে। প্রতিটি অটোয় লাগানো হবে ‘হাই সিকিউরিটি নম্বর প্লেট’। এই কাজ শেষ করে ফেলতে হবে ৩০ জুনের মধ্যে। অটোয় চালকের সিটের পিছনে সরকারি হেল্পলাইন নম্বর লিখে রাখতে হবে। শুধু এই নির্দেশটি ছাড়া কোনও কিছুই কার্যকর হয়নি। এমনকী, মন্ত্রী নির্দেশ দিলেও পরিবহণ দফতরই এখনও ‘হাই সিকিউরিটি নম্বর প্লেট’ লাগানোর কাজ শুরু করে উঠতে পারেনি।

পরিবহণ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, লোকসভা নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে। এই সময়ে অটোচালকদের বিরুদ্ধে কড়া অভিযান চালিয়ে বিরাগভাজন হতে চায় না সরকার। ঠারেঠোরে তা স্বীকার করে নিচ্ছেন আইএনটিটিইউসি-র নেতারাও। এক নেতার কথায়, “নির্বাচনের জন্য এখন একটু ঢিলে দেওয়া হয়েছে। ভোট শেষ হলে আবার অভিযান শুরু হবে।”

তবে আইএনটিটিইউসি নেতা মেঘনাথ পোদ্দারের মতে, “অটোর নথিপত্র নিয়মিতকরণের কাজ শুরুর কথা সরকার ভাবছে। ভোট শেষ হলেই শুরু হবে। তার পরে বেআইনি অটোর দৌরাত্ম্য অনেকটাই কমবে।” তবে ভোটের জন্যই যে অটোর বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ, এমনটা মানছেন না পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। তিনি বলেন, “অভিযান ঠিকই চলছে। আমাদের পুরো পরিস্থিতির উপরে নজরও রয়েছে। তবে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য কোথাও কোথাও একটু ছাড় দেওয়া হতে পারে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement