বেহালা ট্রাম ডিপো এলাকা
মেট্রোর নতুন প্রকল্পের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে প্রস্তাবিত কয়েকটি স্টেশনের নামকরণ করে দিয়েছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চে তখন হাজির প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল, তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও।
দিনটা ছিল ২০১০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। সাড়ে তিন বছর পরে কার্যত ‘বিশ বাঁও জলে’ জোকা থেকে বি বা দী বাগ পর্যন্ত নতুন মেট্রো প্রকল্পের কাজ। জোকা থেকে তারাতলা পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের জন্য উড়ালপুল এবং কয়েকটা স্টেশনের কাঠামো তৈরির কাজ চললেও প্রকল্পের বাকি অংশে নির্মাণকাজ শুরুই হয়নি।
এ নিয়ে বিভ্রান্ত জোকা, ঠাকুরপুকুর, সখেরবাজার, চৌরাস্তা, বেহালার বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা। অনেকে বলছেন শহর জুড়ে সৌন্দর্যায়ন হচ্ছে। ওই লাইনে মেট্রো পরিষেবা চালুর আশা নেই। উড়ালপুলের উপরে তাই বাগান করে দিলে, অন্তত সকলের সময় কাটানোর ভাল একটা জায়গা হতে পারে!
সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কারণ হয়তো অসঙ্গত নয়। তাঁদের বক্তব্য, উড়ালপুলের কাজের জেরে ডায়মন্ড হারবার রোডে যানবাহনের শ্লথ গতি, রাস্তার মাঝখানে লোহার ‘দেওয়াল’ থাকায় এক দিক থেকে অন্য দিকে যাতায়াতের সমস্যা, রাস্তায় নির্মাণসামগ্রী ছড়িয়ে থাকার জেরে দুর্ঘটনায় সকলে জেরবার। মেট্রো পরিষেবা চালুর কথা বলে ডায়মন্ড হারবার রোড এবং তার সমান্তরাল জেমস লং সরণিতে নির্বিচারে দু’ধারের গাছও কাটা হয়েছে। কিন্তু আখেরে কোনও লাভ হয়নি এলাকাবাসীর।
ঠাকুরপুকুরের ৩এ বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা সুনীলকুমার হাজরার কথায়, “তারাতলার পর থেকে বি বা দী বাগ পর্যন্ত মেট্রোর কাজ হবে কি না, কেউ জানে না। কবে কাজ শেষ হবে, তা-ও জানানো হচ্ছে না।” চৌরাস্তা নতুনপাড়ার সুশোভন দাস বলছেন, “তাড়াহুড়ো করে মেট্রোর কাজ শুরু হল। বাড়ির সামনে থেকে মেট্রোয় উঠে ধর্মতলায় পৌঁছনোর স্বপ্ন দেখতাম। এখন বাসে তারাতলা পৌঁছতেই হিমশিম খেয়ে যাই।” পথচলতি কয়েক জন বললেন ওই কাজ কবে শেষ হবে বা আদৌ হবে কি না, সেটা যদি ব্যানার-হোর্ডিংয়ে মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, তা-হলে হতাশা একটু হলেও কাটবে।
মেট্রো সূত্রের খবর, জোকা থেকে বি বা দী বাগ পর্যন্ত ১৬.৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ লাইনে মেট্রোর পরিকাঠামো তৈরির জন্য ২০১০-১১ সালে বাজেট বরাদ্দ করা হয়। তার মধ্যে ৫.১১ কিলোমিটার লাইন মাটির নীচে সুড়ঙ্গ দিয়ে যেত। ২০১২-’১৩ সালে জোকা থেকে আইআইএম এবং ডায়মন্ড পার্ক পর্যন্ত মেট্রোর লাইন সম্প্রসারণের কথা ঘোষণা করা হয় রেল বাজেটে। পরিকল্পনা ছিল, জোকা থেকে ডায়মন্ড হারবার রোড, খিদিরপুর রোড, গুরু নানক সরণি, হেমন্ত বসু সরণি দিয়ে ধর্মতলায় পৌঁছবে নতুন লাইন।
কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তারাতলার পরে পরিকাঠামো গড়তে গিয়ে। রেল মন্ত্রক সূত্রের খবর, তারাতলায় জমির সমস্যা রয়েছে। অস্থায়ী ভাবে কাজ করার জন্য টাঁকশালের সামনের কিছুটা জমি ব্যবহারের জন্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রক অনুমতি দেয়নি। তাদের যুক্তি ছিল, টাঁকশাল নিরাপত্তার দিক দিয়ে স্পর্শকাতর জায়গা। সেখানে খোঁড়াখুড়ি করলে সমস্যা হতে পারে। রেল মন্ত্রকের এক কর্তা জানান, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অধীর চৌধুরী, পশ্চিমবঙ্গ থেকে রেল মন্ত্রকের সব মন্ত্রীই এ নিয়ে দরবার করেছেন। কিন্তু অনুমতি মেলেনি।” এ ছাড়াও, ওই এলাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষ-সহ আরও কয়েকটি সংস্থারও জমি রয়েছে। রেল সূত্রের খবর, ওই মেট্রোর রুটে রয়েছে সেনাবাহিনীর জমিও। সেখানেও কাজের অনুমতি মেলেনি। মেট্রোর মুখপাত্র রবি মহাপাত্র বলেন, “ওই প্রকল্পের কিছুটা অংশ মাটির নীচ দিয়ে তৈরি করতে হবে। ব্রিগেড-সহ পুরো এলাকাটাই সেনার নিয়ন্ত্রণে। নিরাপত্তাজনিত কারণে তারা অনুমতি দিতে চাইছে না। কথাবার্তা চলছে।”
এমনই পরিস্থিতিতে কাজ শেষের অপেক্ষায় জোকার ইএসআই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলি থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান ওই হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে আসেন একের পর এক রোগী। হাসপাতালের মূল প্রবেশপথের একেবারে সামনে পরিকাঠামো গড়ছে মেট্রো। সমস্যা হলেও শহরের উন্নয়নের দিকে তাকিয়ে তা আপাতত মেনে নিচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সুপার কল্যাণকুমার পাল, ডেপুটি সুপার পরিমল মাজি কিন্তু একই সঙ্গে বলন, “গেটের অর্ধেক অংশই কার্যত আটকে গিয়েছে। কখনও অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকতেও সমস্যা হয়। দুর্ঘটনার আশঙ্কা তো রয়েছেই। যেটুকু জায়গা খোলা থাকে, সেখানে বাস, অটোর ভিড় সমস্যাটা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়।”
বেহালার বিদ্যাসাগর হাসপাতালের সামনেও ছবিটা অনেকটা একই রকম। রাস্তার মাঝখানে মেট্রোর কাজের জন্য লোহার কাঠামো রাখা। তারাতলার দিক থেকে আসা রোগীর গাড়ি অনেক ঘুরিয়ে ঢুকতে হয় হাসপাতালে।
তবে, জোকা-বিবাদী বাগ প্রকল্প শেষ হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী মেট্রো কর্তৃপক্ষ। তাঁদের কথায়, “সদর্থক কথাবার্তা চলছে। প্রকল্পও বন্ধ হয়নি। প্রশাসনের সব দফতরের সহযোগিতা পেলে দ্রুত কাজ শেষ করা হবে।”
ছবি: অরুণ লোধ