বিতর্কের কেন্দ্রে এই সেই ছবি। ছবি: শৌভিক দে।
জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানা আপত্তি। যার জেরে বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণে বাধার অভিযোগও বিস্তর। এ বার সেই রাজ্যেই শাসকদল পরিচালিত এক পুরসভার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের জমি দখল করে রাখার অভিযোগ উঠেছে। ওই দখলদারির ফলে একটি রুগ্ণ সংস্থা পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনাও মার খাচ্ছে বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় কর্তারা।
তৃণমূলচালিত দক্ষিণ দমদম পুরসভার অন্তর্গত লেকটাউন-দক্ষিণদাঁড়িতে ‘বার্ড জুট অ্যান্ড এক্সপোর্ট’ সংস্থার জমি ঘিরে বিতর্কের সূত্রপাত। সরকারি সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রকের অধীনস্থ ন্যাশনাল জুট ম্যানুফ্যাকচারারস কর্পোরেশন (এনজেএমসি)-এর এই শাখা সংস্থাটি বেশ কিছু কাল ধরে রুগণ। জিইয়ে তোলার লক্ষ্যে সেটিকে বোর্ড ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল রিকনস্ট্রাকশন (বিআইএফআর)-এ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ দমদম পুর-কর্তৃপক্ষের দখলদারি সেই পরিকল্পনায় বাদ সেধেছে বলে অভিযোগ। কী রকম?
বস্ত্র মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশন (জেএনএনইউআরএম) প্রকল্পের আওতায় জলের ওভারহেড ট্যাঙ্ক তৈরির জন্য ওই জমিটিকেই বেছে নিয়েছে পুরসভা। শুধু তা-ই নয়, পরে ওখানে পুরসভার জঞ্জাল বিভাগের ‘কমপ্যাক্টর’ যন্ত্রও বসানো হয়েছে। সব মিলিয়ে জমি কার্যত সংস্থার বেহাত হয়ে গিয়েছে, যার প্রভাব পুরোদস্তুর পড়েছে পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়ায়।
মন্ত্রকের খবর, সমস্যাটি হঠাৎ গজিয়ে ওঠেনি। বছর তিনেক আগেই মন্ত্রকের তরফে সে দিকে রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। ২০১৩-য় তদানীন্তন বস্ত্র-সচিব জোহরা চট্টোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যসচিবকে চিঠি লিখে সুরাহার আর্জি জানান। ২০১৪-র গোড়ায় কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী কাবুরু সাম্বাশিব রাও নিজেই চিঠি লেখেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, যাতে কেন্দ্রীয় সংস্থার জমি দখলের জন্য দক্ষিণ দমদম পুরসভার ভাইস-চেয়ারম্যানের দিকে নির্দিষ্ট ভাবে আঙুল তোলা হয়।
কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। ইতিমধ্যে কেন্দ্রে সরকার বদল হয়েছে। মোদী সরকারের বস্ত্রমন্ত্রী সন্তোষকুমার গঙ্গোয়ার কয়েক দিন আগে কলকাতায় এসেছিলেন। রাজ্যের সঙ্গে তাঁর আলোচনায় বার্ড জুটের জমির প্রসঙ্গটি উঠে এসেছিল। তার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি বলে মন্ত্রক সূত্রের অভিযোগ।
এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় জুট কমিশনার সুব্রত গুপ্ত জমি উদ্ধারে তৎপর হয়েছেন। ৪ ফেব্রুয়ারি বিধাননগরের পুলিশ কমিশনারকে এ ব্যাপারে তিনি চিঠি লিখে প্রতিকার চেয়েছেন। তাতে সুব্রতবাবু এ-ও আক্ষেপ করেছেন, রুগ্ণ সংস্থার জমি এ ভাবে দখল হয়ে থাকায় সংস্থার পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ বাধা পাচ্ছে।
একই অভিযোগ জানিয়ে বার্ড জুটের চেয়্যারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর (সিএমডি) কুশল ভাদুড়িও চিঠি দিয়েছেন বিধাননগরের পুলিশ-কর্তাকে। তার পরেও কোনও ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। কুশলবাবুর কথায়, “সম্প্রতি কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রীর বৈঠকেও প্রসঙ্গটি উঠেছিল। তবু রাজ্যের তরফে কোনও সদর্থক পদক্ষেপ হয়নি।”
পুরসভার কী বক্তব্য? কেন্দ্রীয় অভিযোগে ভাইস চেয়ারম্যানের নামই বা আলাদা ভাবে উঠছে কেন?
দক্ষিণ দমদম পুর-কর্তৃপক্ষ অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য: ওই জমির মালিকানা নিয়ে গোলমাল রয়েছে। এ নিয়ে আদালতে মামলাও চলছে। তা হলে ওই জমিতে পুরসভা কাজ করল কেন?
পুর-কর্তারা ‘জনস্বার্থের’ যুক্তি দিচ্ছেন। পুর-সূত্রের আরও ব্যাখ্যা: ওই তল্লাটে জলের ট্যাঙ্ক তৈরি ও কমপ্যাক্টর বসানোর কথা চলছিল। দক্ষিণ দমদম পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান তথা বিধাননগরের তৃণমূল বিধায়ক সুজিত বসুই প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্বে ছিলেন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তার নাম আসছে। সুজিতবাবুও নিজেও বলছেন, “ওটা পরিত্যক্ত জমি। তাই ওখানে জলের ট্যাঙ্ক বানানো হয়েছে।”
কিন্তু পরিত্যক্ত হলেও দিল্লি যে বলছে, জমিটা তাদের অধীনস্থ সংস্থার!
সুজিতবাবুর জবাব, “জমিটা আদৌ বার্ড জুটের কি না, তা নিয়েই ধন্দ রয়েছে। কোর্টে মামলাও চলছে।” এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, মামলার জালে জড়ানো এমন বিতর্কিত জমিতে ট্যাঙ্ক-কমপ্যাক্টর বসাল কেন পুরসভা? যা শুনে সুজিতবাবুর মন্তব্য, “ওটা তো কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। জনস্বার্থে ট্যাঙ্ক বসেছে। এলাকায় জলের সমস্যা মিটেছে। তা ছাড়া একটা জঞ্জাল কমপ্যাক্টর বসাতে কতটুকু জমি লাগে!”
পাশাপাশি বার্ড জুট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টা তিরও ছুড়েছেন বিধায়ক-পুরকর্তা। তাঁর অভিযোগ: সংস্থার সঙ্গে জড়িত কিছু অসাধু লোক জমি দখল করিয়ে দোকানপাট করলেও ওখানকার কর্তারা চোখ বুজে আছেন। “অথচ জনস্বার্থে উন্নয়নের কাজ হলেই ওঁদের গা জ্বালা করছে!” কটাক্ষ সুজিতবাবুর।