আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ এক জন বিচিত্র ব্যক্তিত্ব। তিনি একই সঙ্গে তবলার কুলগুরু, সেই সঙ্গে খেয়াল এবং ঠুংরির এক জন গুরু। যাঁর কাছে একাধিক বড় শিল্পী তবলা এবং ধ্রুপদী সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। আবার এই মানুষটিই আধুনিক বাংলা গানের এক জন জিনিয়াস। জিনিয়াস ছাড়া আর কোনও শব্দে তাঁকে বর্ণনা করা যায় না। সঙ্গীতের এ হেন স্তম্ভ সেই তিনিই আবার সুকুমার রায়ের কবিতায় সুর দিয়ে আকাশবাণীর রম্যগীতিতে রেকর্ড করেছিলেন। আমি নিজে শুনেছি— গন্ধ বিচার, দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম এবং রোদে রাঙা ইটের পাঁজা— কবিতায় নিজে সুর দিয়ে, সহ-শিল্পীদের সঙ্গে গেয়ে সে এক অনবদ্য কাজ করেছিলেন। এ ছাড়াও আধুনিক বাংলা গানে অসামান্য সব সুর করেছেন। আমার মনে হয়, হিমাংশু দত্তের পর একমাত্র তাঁর সুরেই ধ্রুপদী আঙ্গিক, আধুনিক ইডিয়ম এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সহাবস্থান ঘটেছিল।
আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কোনও রকম মূল্যায়ন কোনও দিনই হয়নি। কারণ এই জাতি সঙ্গীতকারের মূল্যায়ন করতে জানে না। বয়স হিসেব করলে আমার তাঁকে জ্যাঠামশাই সম্বোধন করা উচিত। কিন্তু আমি সারা জীবন ‘জ্ঞানদা’ বলেই ডেকে এসেছি। সেই শিল্পীর হাতে কানাই দত্ত, শ্যামল বসু, শঙ্কর ঘোষ, নিখিল ঘোষের মতো তবলিয়ারা তৈরি হয়েছেন। এক সময় তিনি মীরা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ক্লাসিকাল কণ্ঠশিল্পীদেরও তালিম দিয়েছেন। এঁরা দু’জন বলতে গেলে তাঁরই হাতে তৈরি। তেমনই, পরবর্তী কালে অরুণ ভাদুড়ি এবং অজয় চক্রবর্তীর গুরু ছিলেন তিনি। সেই মানুষটির নির্দেশনায় কৃষ্ণচন্দ্র দে, বাণী কোনার, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায় প্রমুখ গেয়েছেন, ভাবলে অবাক লাগে।
এক বার দিলীপকুমার রায়ের একটি রেকর্ডিং-এ আশ্চর্য এক কাণ্ড করলেন। তানপুরার তারের উপর হাতুড়ির কাঠের অংশটি দিয়ে চেপে তিনি গিটারের মতো আওয়াজ বের করলেন। হারমোনিয়াম বাদনেও তিনি প্রকৃত অর্থে গুরু ছিলেন। আচার্য আমির খান এবং আচার্য বড়ে গোলাম আলি খান ‘জ্ঞানবাবু’কে এক বার সহ-শিল্পী হিসেবে পেলে আর কাউকে চাইতেন না। তিনি নিজে গানও গাইতেন। তবে সে যে ভীষণ সচকিত করে তুলত এমন নয়। তিনি স্বরচিত আধুনিক গান গেয়ে গ্রামোফোন রেকর্ড করেছিলেন গত শতকের তিনের দশকে প্রথম। আকাশবাণীর মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানে আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের অসামান্য অবদান ছিল। তবে তিনি নেপথ্যে থেকে এই কাজ করেছিলেন।
আচার্য জ্ঞানপ্রকাশকে নিয়ে বলতে গেলে আমার কয়েক বছর লাগবে। লিখতে গেলেও লিখতে হবে কয়েক হাজার পৃষ্ঠা। তবে দুঃখের বিষয় একটাই, আমরা তাঁর শুধু ধ্রুপদী দিকটাই দেখি। এটা আমাদের একদেশদর্শীতা। আধুনিক গানেও তাঁর কৃতিত্ব সমান মানের। সঙ্গীতে তিনি কোনও কালোয়াতি পছন্দ করতেন না। চরম আধুনিক মানুষ ছিলেন। আমাকে দিয়ে তিনি এক বার, আমার তখন ১৭ বছর বয়স, একটি ভজন গাইয়েছিলেন। সে সঙ্গে তিনি হাওয়াইয়ান গিটারে সঙ্গত করেছিলেন রিহার্সালের সময়। এই ছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। অকারণ ক্লাসিকিয়ানা তিনি সযত্নে পরিহার করেছেন সারাজীবন। শাস্ত্রীয় এবং আধুনিক সঙ্গীতের এমন কম্বিনেশন সারা ভারতে আর কারওকেই দেখিনি।
ধ্রুপদী সঙ্গীত বললেই আমাদের চোখের সামনে ভাসে ভীষণ গম্ভীরমুখো, বেরসিক ওস্তাদ আর পণ্ডিতদের মুখ। আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, যাঁর মতো ওস্তাদ এবং পণ্ডিত ইতিহাসে বিরল, সঙ্গীতে হাস্য পরিহাসের একটা ভূমিকা করে দিয়েছিলেন। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সুকুমার রায়ের কবিতায় তাঁর সুরারোপ ও গান। এবং এই জায়গা থেকেই আকাশবাণীর একাধিক অনুষ্ঠানে তিনি তবলার বোলের মাধ্যমে বাংলার নানা রঙ্গরসিকতা ফুটিয়ে তুলতেন। যেমন একটি বেতার অনুষ্ঠানে তিনি এক দিকে পরশুরামের ‘ভূষণ্ডির মাঠ’ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছিলেন এবং তার পরেই সেই কথাগুলি তবলার বোলের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করছিলেন। একই সঙ্গে কণ্ঠচর্চা যে কত আনন্দময় দিক, এটা যে শুধু একটা সশ্রম কারাদণ্ডের সামিল কিছু নয়, তা আমাদের মতো আনাড়ি লোকদের জানাতে গিয়ে আকাশবাণীতে তিনি একাধিক অনুষ্ঠান করেছিলেন। যেখানে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা গলা সাধার কম্পোজিশন গাইতেন।
আচার্য জ্ঞানপ্রকাশই প্রথম সমবেত কণ্ঠে দস্তুরমতো খেয়াল পরিবেশন করেন। আমরা বড় হতভাগ্য জাতি, তাই এই কীর্তিগুলোর কোনও রেকর্ডিংও আর নেই। এই অদ্ভুত মানুষটিকে এই জাতি কোনও দিনই বোঝেনি। আজ আমি আমার জীবন সায়াহ্নে এই ভেবে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছি যে আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সান্নিধ্যে আমি আসতে পেরেছিলাম। তাঁর বেশ কিছু সৃষ্টির প্রসাদ আমি পেয়েছি। আমার নিজের রচনায় থেকে থেকেই আচার্য জ্ঞানপ্রকাশের প্রভাব এসেছে। সে রকম শ্রোতা নেই, তাই তাঁরা বুঝতে পারেননি।