তিন-তিনটে মানুষকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছিল সে। যার মধ্যে দু’জন ফুটফুটে দুুই বালিকা। তার পরেও এতটুকু না বিচলিত না হয়ে মেটিয়াবুরুজে ভাগ্নে ইরফানের বরযাত্রী হিসেবে বিয়েবাড়ি চলে গিয়েছিল একবালপুর-কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত সিকন্দর। মৃতদেহ তিনটিকে নিজের দোকানে পোঁতার ব্যবস্থা সে করে বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে এসে। হাতুড়ি-হত্যার তদন্তে মঙ্গলবার এমনটাই দাবি করল পুলিশ। তাদের দাবি, জেরায় সিকন্দর জানিয়েছে ২৯ মার্চ দুপুরে মা ও দুই মেয়েকে খুন করার পরে, সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ সে একবালপুরে ফিরে আসে এবং ৩০ মার্চ ভোরে তার দোকানের ভিতর মৃতদেহ তিনটি পুঁতে দেয়।
একবালপুরের সুধীর বসু রোডের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ এ-ও জেনেছে, খুনের কয়েকদিন আগে থেকেই সিকন্দর ও তার সঙ্গীরা দোকানের মেঝেয় গর্ত খুঁড়ছিল। তবে ২৯ মার্চ গর্ত খোঁড়ার জন্য কয়েক জন মিস্ত্রিকে কাজে লাগায় সিকন্দর। ২ এপ্রিলও মিস্ত্রি লাগানো হয় দোকানের মেঝে প্লাস্টার করার জন্য। প্লাস্টারের কাজে যে মিস্ত্রিদের লাগানো হয়েছিল, তাঁদের খোঁজ করছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, যে দু’জন ওই দোকানে গর্ত খোঁড়ার কাজ করেছিলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একবালপুর থানায় আনা হয়। তাঁদের বাড়ি গার্ডেনরিচ সার্কুলার রোডে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েক জন এ দিন দাবি করেন, ২ এপ্রিল সিকন্দরের ভাগ্নের বৌভাতের অনুষ্ঠান ছিল। ওই দিন সিকন্দরকে দেখে তাঁদের মনে হয়েছিল, সে কোনও ভাবে মানসিক চাপে রয়েছে। কী কারণে সে মানসিক চাপে রয়েছে, তা জিজ্ঞাসাও করেছিলেন তাঁরা। ওই বাসিন্দাদের দাবি, সিকন্দর তাঁদের প্রশ্নের কোনও জবাব দেয়নি।
মা ও দুই মেয়ের খুনে অভিযুক্ত সিকন্দরের উপর সুধীর বসু রোডের বাসিন্দাদের একাংশ এখনও ক্ষুব্ধ। এ দিন বেলা বারোটা নাগাদ পাড়ার জনা দশেক যুবক সিকন্দরের সেলুনে ভাঙচুর চালায়। তারা চড়াও হয় খুনের ঘটনায় অন্য অভিযুক্ত সিকন্দরের ভাইপো মহম্মদ আমিনের বাড়িতেও। আমিনের বাড়িতে তার ঠাকুরমা তমান্না খাতুনকে গিয়ে তারা শাসিয়ে আসে, অবিলম্বে পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে না গেলে পরিণতি খারাপ হবে। ওই বৃদ্ধাকে তারা নিগ্রহও করে বলে অভিযোগ। আমিনের বাড়িতে চড়াও হয়ে ওই যুবকেরা প্লাস্টিকের কয়েকটি বালতি ভেঙে দেয়। তমান্না এ দিন বলেন, “আমিন অপরাধী প্রমাণিত হলে ও শাস্তি পাক। কিন্তু আমি তো কোনও দোষ করিনি। আমার উপরে কেন চড়াও হচ্ছে ওরা?”
মৃতদেহ তিনটি উদ্ধারের পরে তিন দিন কেটে গিয়েছে। এখনও পুষ্পাদেবীর বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেনি ফরেন্সিক দল। লালবাজারের এক কর্তা জানিয়েছেন, মৃতদেহ উদ্ধারের পরেই পুষ্পাদেবীদের ফ্ল্যাটটি ‘সিল’ করে দেওয়া উচিত ছিল একবালপুর থানার পুলিশের। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে অগুনতি লোক ওই ফ্ল্যাটে ঢুকেছে। ফলে কোনও নমুনা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে, ফরেন্সিক দলের ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে নমুনা সংগ্রহের কথা রয়েছে বলে ওই কর্তা জানান।
লালবাজার সূত্রের খবর, এ দিন সিকন্দরকে সঙ্গে নিয়ে এলাকার বেশ কয়েকটি জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়। যে দোকান থেকে খুনের পরে ব্যবহৃত ট্রাঙ্ক ও মেঝে প্লাস্টার করার সিমেন্ট, বালি কেনা হয়, সেই দোকানে নিয়ে যাওয়া হয় অভিযুক্তকে। এর আগে সোমবার রাতে কয়েকটি জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে কয়েকটি মোবাইল ফোনের সিম উদ্ধার করেছিল পুলিশ। পুলিশের দাবি, খুনের পরে ওই সিমগুলি থেকে অভিযুক্তেরা পুষ্পাদেবীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।
পুলিশ জানায়, খুনের পরে সিকন্দর এবং তার এক সঙ্গী পুষ্পাদেবীর ফ্ল্যাটের আলমারি খুলেছিল। সেখান থেকে কয়েক লক্ষ টাকার জীবনবিমার নথি এবং বিভিন্ন ব্যাঙ্কের পাশ বই নিয়ে যায় অভিযুক্তরা। ধৃতদের জেরা করে কিছু নথি উদ্ধার হয়েছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। লালবাজারের এক কর্তা বলেন, “সিকন্দরদের ধারণা ছিল আলমারিতে নগদ টাকা রয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে হাজার টাকার বেশি মেলেনি।”
পুলিশ জানায়, ৩১ মার্চ পুষ্পাদেবীর বাবা পরেশনাথ সিংহ একবালপুর থানায় তাঁর মেয়েকে অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন। তার পরেই ওই মহিলার বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করে দেওয়া হয়। যার একটি অ্যাকাউন্টে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করা রয়েছে বলে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, ওই টাকা হাতানোর তালে ছিল সিকন্দর।