দেশপ্রিয় পার্ক এলাকার এক খুঁটিপুজোয় (বাঁ দিক থেকে) শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দেবাশিস কুমার, সোহম, গার্গী রায়চৌধুরী, রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। রবিবার। ছবি: রাজীব বসু
বাঙালির দেবকুলে নতুন সদস্য ‘খুঁটি’!
লম্বা সিড়িঙ্গে চেহারা। তার উপরে ফুলের মালা, রঙিন কাপড় জড়ানো। সব মিলিয়ে একটা ‘কন্দর্পকান্তি’ ব্যাপার! আর এই নতুন সদস্যকে নিয়েই প্রাক-দুর্গাপুজো উৎসবে মেতে উঠেছে মহানগরের ক্লাবগুলি। খুঁটির এই পুজো ঘিরে ফেস্টুন-ফেসবুকে প্রচারের ঢল। পুজো শেষে নেতা-অভিনেতাদের নিয়ে লাঞ্চের ঢালাও ছবিতে উপচে পড়ছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট।
এর চল অবশ্য নতুন নয়। রথযাত্রার দিন সাবেক বাড়ির দুর্গামূর্তির কাঠামোয় পুজো পড়ত। সে দিন থেকেই শুরু হত দিন গোনা। সাবেক পুজো ভেঙে ভেঙে গড়ে উঠেছে বারোয়ারি, সর্বজনীন পুজো। আর সেই কাঠামো পুজোর আঙ্গিকেই গড়ে উঠেছে খুঁটি পুজো। এক পুজোকর্তার ব্যাখ্যা, কাঠামো পুজো করা সম্ভব হয় না। তাই মণ্ডপের খুঁটিকেই পুজো করে উৎসবের সূচনা করা হয়।
শহরের পুজোকর্তারা বলছেন, খুঁটিপুজোর আমদানি বেহালা থেকে। ওই রথের দিনই খুঁটিপুজো হত আগে, নম নম করে। অনেকটা ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের বারপুজোর মতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে খুঁটিপুজো নিয়ে পুজো কমিটির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের বড় বড় হোর্ডিংয়ে এই মাস দুই আগেও মুখ ঢেকেছিল কলকাতার। বিশ্বকাপ ফুটবল এসে যাওয়ায় মমতা, মোদীর হোর্ডিংয়ের জায়গা নিয়েছে মেসি, নেইমারের মুখ। তবে তারই মাঝে জায়গা করে নিয়েছে খুঁটির পুজোর হোর্ডিংও।
এই শতকের গোড়ায় বেহালার একাধিক পুজো দিয়ে খুঁটিপুজোর রমরমা শুরু। পরে দক্ষিণ থেকে উত্তর, বেলেঘাটা থেকে বৈষ্ণবঘাটা সংখ্যাটা বাড়ছে। রবিবার রথের দিনে ত্রিধারা সম্মিলনী, রাজডাঙা নব উদয় সঙ্ঘ, সন্তোষপুর ত্রিকোণ পার্ক, বেহালা ক্লাব, বড়িশা ক্লাব, বসাকবাগান, সন্তোষপুর অ্যাভিনিউ সম্মিলনী, হরিদেবপুর অজেয় সংহতি, ৪১ পল্লি, আহিরীটোলা সর্বজনীন, দমদম পার্ক ভারতচক্র-সহ কিছু ক্লাবে খুঁটিপুজো হয়েছে। পাটুলি কেন্দুয়ার একটি ক্লাব আবার খুঁটিপুজোর সঙ্গে মেসি, নেইমার-যজ্ঞেরও ব্যবস্থা রেখেছিল। সন্তোষপুরের অ্যাভিনিউ সাউথে শিশুদের মেসি-নেইমার সাজানো হয়। পুজো আর বিশ্বকাপ মিলেমিশে একাকার। সন্তোষপুরের এক উদ্যোক্তার মন্তব্য, “বিশ্বকাপ আর ক’দিন! তার পরে তো পুজোই বিশ্বকাপ।”
এক সময়ে পয়লা বৈশাখে ময়দানের ক্লাবগুলি বারপুজো করে মরসুম শুরু করত। অনেকটা সেই ধাঁচে এখন পয়লা বৈশাখেই খুঁটিপুজো সেরে নেন অনেকে। অনেকে আবার নজর কাড়তে অক্ষয় তৃতীয়া, বুদ্ধপূর্ণিমায় খুঁটিপুজো করছেন। কোনও কোনও ক্লাব আবার নিজেদের সুবিধা মতো রবিবার বা ছুটির দিনে খুঁটিপুজো সেরেছে। তবে রথের দিনই খুঁটিপুজো চরমে পৌঁছেছে।
এই খুঁটি দেবতার মন্ত্রটা কী? কলকাতার এক পুরনো ক্লাবের পুরোহিত কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্য বলছেন, ভূমিতে খোঁড়াখুঁড়ির আগে বাস্তুদেবতাদের পুজো দিতে হয়। খুঁটিপুজোও তা-ই। উপরন্তু ‘খুঁটিরূপেণ সংস্থিতা’ স্তম্ভকে ও বিশ্বকর্মাকেও পুজো করা হয়। “বাড়ির যেমন ভিতপুজো, এটাও তেমন মণ্ডপের ভিতপুজো”, বলছেন তিনি।
তবে অনেকে এ-ও বলেন, কোন ক্লাবের খুঁটিপুজোর জোর কতটা, তা নির্ভর করে ক্লাবকর্তার খুঁটির জোরের উপরে। নেতামন্ত্রীদের পুজোয় যেমন টলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ভিড় করেন। আবার পাড়ার গলির পুজোয় কাউন্সিলরও ফিরেও তাকান না।
খুঁটিপুজোর হোর্ডিংয়েও খুঁটির জোর লক্ষ্যণীয়। শহর জুড়ে হোর্ডিং নিয়ন্ত্রণ করার কথা যাঁর, সেই মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার খুঁটিপুজোর হোর্ডিংয়ে এ বার এক নম্বর। পুজোর হোর্ডিংয়ে পিছিয়ে নেই তিন মন্ত্রী ববি হাকিম, মদন মিত্র এবং অরূপ বিশ্বাসও। তবে খুঁটিপুজোর এই হুজুগে গা ভাসাননি অরূপ। বলছেন, “১৫ বছর আগে সুরুচি সঙ্ঘেই খুঁটিপুজো শুরু করি। এখন সবাই সেই পথে পা বাড়িয়েছে। তাই আমরা আর করছি না।” কিন্তু হোর্ডিং নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা দেবাশিসবাবু কী ভাবে খুঁটিপুজোর হোর্ডিংয়ে গা ভাসাচ্ছেন? তাঁর জবাব, এ সবই সাময়িক। দু’এক দিনের মধ্যেই হোর্ডিং খুলে ফেলা হবে।
রথযাত্রা শেষ। বেজেছে পুজোর ঘণ্টা। কিন্তু খুঁটিপুজো শেষ হয়নি। উল্টোরথের দিনও কেউ কেউ খুঁটিপুজো করবেন। দু’-একটি ক্লাবের ভাবনায় রয়েছে স্বাধীনতা দিবসও!