কসবা-কাণ্ডে নাম জড়ালো জামিনে মুক্ত মুন্নার

মনোজ সাহুর থেঁতলানো, দলা পাকানো শরীরটা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে শিউরে উঠেছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। পুলিশও প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি, এমন ভাবে কে বা কারা পেটাল ওই যুবককে। পরে জানা যায়, এই ঘটনায় যার হাত রয়েছে বলে পুলিশের সন্দেহ, তার নাম মুন্না পাণ্ডে। পুলিশের খাতায় এখন সে ফেরার। জোড়া খুনের মামলায় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় তার।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৪ ০১:৫৩
Share:

মনোজ সাহুর থেঁতলানো, দলা পাকানো শরীরটা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে শিউরে উঠেছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। পুলিশও প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি, এমন ভাবে কে বা কারা পেটাল ওই যুবককে। পরে জানা যায়, এই ঘটনায় যার হাত রয়েছে বলে পুলিশের সন্দেহ, তার নাম মুন্না পাণ্ডে। পুলিশের খাতায় এখন সে ফেরার। জোড়া খুনের মামলায় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় তার।

Advertisement

তবে ওই মামলায় হাইকোর্ট থেকে বছর কয়েক আগে জামিনে ছাড়া পেয়ে মুন্না এখন কসবা এলাকায় তাণ্ডব চালাচ্ছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। এক পুলিশকর্তার কথায়, নিম্ন আদালতে খুনের সাজা ঘোষণার পরে হাইকোর্টের নির্দেশে জামিনে থাকায় ফের এলাকায় ফেরে মুন্না। কয়েক বছরের মধ্যে আবার দলবল তৈরি করে ঠিকাদারি-রাজ কায়েম করে ফেলেছে সে।

পুলিশ জানায়, কসবার বোসপুকুরে সপ্তাহ দু’য়েক আগে মনোজ সাহুর খুনেও মুন্না মূল অভিযুক্ত। মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে মনোজের অভিযোগ ছিল, যারা তাঁকে লোহার রড, ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেটায়, তারা মুন্নার সঙ্গী। পুলিশ বলছে, তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগে এফআইআর দায়ের হয়েছে জেনেই মুন্না পালিয়েছে। ঘটনার পর থেকে তার বোসপুকুর রোডের ফ্ল্যাটে তালা। মোবাইল বন্ধ। শেষ টাওয়ার লোকেশন ছিল বাইপাসের রুবি মোড়। এক তদন্তকারীর কথায়, ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা মুন্না বছর পনেরো আগে বোসপুকুরে মামাবাড়িতে এসে ওঠে। তেইশ বছর বয়েসে জোড়া খুনের ঘটনায় সে গ্রেফতার হয়েছিল। মুন্নার মামাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ঝাড়খণ্ডেও মুন্নার হদিস করার চেষ্টা হচ্ছে বলে জানান তদন্তকারীরা। গ্রেফতারি এড়াতেই যে সে গা-ঢাকা দিয়েছে, মুন্নার ঘনিষ্ঠ মহলে খোঁজখবর করে সে ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত পুলিশ।

Advertisement

কেন খুন হল মনোজ?

পুলিশ জানায়, এর পিছনে রয়েছে ঠিকাদারদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। প্রাথমিক তদন্তে গোয়েন্দারা জেনেছেন, মুন্নার বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর মনোজ পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। নতুন বাড়ি তৈরি হলে তিনি বিদ্যুতের লাইন তৈরির কাজ পেতেন। কয়েকটি বহুতল তৈরি নিয়ে ঠিকাদারদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বেশ কিছু দিন ধরে গোলমাল চলছিল। তদন্তকারীরা জেনেছেন, সেই ঘটনার জেরেই মনোজকে মুন্নার লোকজন পেটায়। হাসপাতালে মারা যান তিনি।

এই খুনের পরে প্রকাশ্যে এসেছে কসবা এলাকায় ঠিকাদারদের গোলমাল। পুলিশ জানায়, ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের বরাত নেওয়া, পুরনো বাড়ির দখল নিয়ে ভেঙে ফেলা, ভাঙা ইটপাথর সরানো অথবা পুকুর বুজিয়ে জমি তৈরির বরাত নেওয়ার জন্যই এই গোলমাল চরমে উঠেছে।

পুলিশ জানাচ্ছে, মুন্না বা তার বিরুদ্ধ গোষ্ঠী এমনই ঠিকাদার। তদন্তকারীরা জানান, এই ঠিকাদারদের অধীনে বাড়ির দখল নেওয়ার মস্তান-বাহিনী রয়েছে। রয়েছে তাদেরই বেঁধে দেওয়া দামে ইট, লোহার রড, বালি, সিমেন্ট, পাথর সরবরাহের লোক। জল, বিদ্যুৎ লাইনের মিস্ত্রিও সরবরাহ করেন এই ঠিকাদাররাই। কসবার ৯১, ৬৭ ও ১০৭ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে মুন্না পরিচিত। পুলিশ জানায়, প্রোমোটারেরা জমির খোঁজ পেলেই ঠিকাদারেরা তাঁদের কাছে পৌঁছে যান।

প্রোমোটারদের কয়েক জন জানান, বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ফ্ল্যাট বা আবাসন তৈরিতে প্রতি বর্গফুটে খরচ কমবেশি ১৪০০ টাকা। বাড়ি তৈরির প্রথম থেকে শেষ ধাপ পর্যন্ত সব ঝক্কি সামলানোর বিনিময়ে প্রতি বর্গফুটে ৩০০-৪০০ টাকা মুনাফা রাখেন ঠিকাদারেরা। তাঁদের কাজের মধ্যে রাজনৈতিক দল, পুরসভা বা প্রশাসনকে সামলানোও পড়ে বলে পুলিশ জানায়।

পুলিশ জানায়, ২০০৫ সালের জুন মাসে বিমল চক্রবর্তী ও পীযূষ সাহা নামে দুই প্রোমোটার খুন হন। তাঁরা মুন্নার ঠিকাদারিতে কাজ করতে চাননি বলে প্রোমোটারদের একাংশ জানান। ওই জোড়া খুনে জড়িত থাকার অভিযোগে মুন্না-সহ চার জনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। সেই মামলায় আলিপুর দায়রা আদালতের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মুন্না ও বিধান মণ্ডল নামে আর এক জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল মামলা করে মুন্না।

প্রোমোটারদের একাংশের অভিযোগ, হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে মুন্না জেল থেকে বেরিয়ে ফের ঠিকাদারি শুরু করেছে। জেলে থাকাকালীন যারা তার ব্যবসায় ভাগ বসিয়েছিল, এখন তারাই মুন্নার বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর ঠিকাদার।

মুন্নার প্রতিপত্তি কী ভাবে বাড়ল?

এলাকাবাসীরা অনেকেই জানান, ২০১১ সালে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরে শাসকদলের মিছিল-মিটিংয়ে মুন্নাকে দেখা যেত। কসবার অনেক বাসিন্দারই অভিযোগ, পাড়ায় মুন্না ও তার দলবলের দৌরাত্ম্য ক্রমেই বাড়ে। তাদের বিরুদ্ধে মারধর, ভয় দেখানো, তোলাবাজির একাধিক অভিযোগ জমা পড়ে কসবা থানায়। শাসকদলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় পুলিশও মুন্নার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিত না বলে স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ।

বিরোধীদেরও অভিযোগ, শাসকদলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকেই মুন্নার এত বাড়বাড়ন্ত। ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর দীপঙ্কর দে বলেন, “লোকসভা ভোটেও শাসকদলের মিছিলে মুন্নাকে একাধিক বার দেখা গিয়েছে। শাসকদলের প্রভাবেই সব রকম বেআইনি কাজ করে মুন্না।”

কসবার তৃণমূল বিধায়ক তথা দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান অবশ্য মুন্নার সঙ্গে শাসকদলের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, “মুন্না নানা অসামাজিক কাজ করছে বলে পুলিশের কাছে আমিই অভিযোগ করেছি। বলেছি, ব্যবস্থা নিতে।”

কলকাতা পুলিশের ডিসি সন্তোষ পাণ্ডে জানিয়েছেন, সব ধরনের অভিযোগই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পলাতক মুন্নার খোঁজ চলছে। মনোজ-খুনে এখনও পর্যন্ত তার তিন সঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মুন্নাকেও গ্রেফতার করা হবে বলে জানান ডিসি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement