দড়ি বেঁধে টানতেই মুখ দিয়ে রক্ত, উদ্ধার হল না ১২ ঘণ্টাতেও

কুয়ো খুঁড়তে নেমে ধসের নীচে শ্রমিক

দরকার এক ডজন কুয়ো। তার মধ্যে এগারোটা খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল। শেষ কুয়োটিও খোঁড়া প্রায় শেষ। এমন সময়েই ঝুরঝুর করে ধসে পড়ল মাটি-বালি। তাতে চাপা পড়ে গেলেন অমর পাল (৪২) নামে এক শ্রমিক। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর চেষ্টাতেও তাঁকে উদ্ধার করা গেল না!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৪ ০৫:০১
Share:

কুয়োয় পড়ে যাওয়া শ্রমিক অমর পালের খোঁজে তল্লাশি চলছে দমদমের মধুগড়ে। —নিজস্ব চিত্র।

দরকার এক ডজন কুয়ো। তার মধ্যে এগারোটা খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল। শেষ কুয়োটিও খোঁড়া প্রায় শেষ। এমন সময়েই ঝুরঝুর করে ধসে পড়ল মাটি-বালি। তাতে চাপা পড়ে গেলেন অমর পাল (৪২) নামে এক শ্রমিক। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর চেষ্টাতেও তাঁকে উদ্ধার করা গেল না!

Advertisement

রবিবার দমদম মধুগড়ের এই ঘটনায় রাজ্যের দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের বেহাল দশা ফের বেআব্রু হয়ে গিয়েছে। দমকল বা বিপর্যয় মোকাবিলা দল অকুস্থলে পৌঁছলেও তাদের কেউই প্রথমে ওই সরুমুখ কুয়োয় নামতে চাননি বলে অভিযোগ। উপর থেকে তাঁরা শুধু তদারক করতে থাকেন। প্রথম থেকে দফায় দফায় কুয়োয় নেমে ওই শ্রমিককে উদ্ধারের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যান তাঁর সহকর্মীরাই। পরে অবশ্য তাদেরও দু’-এক জন নেমে অমরকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন বলে বিপর্যয় মোকাবিলা দলের দাবি।

ঠিক কী হয়েছিল এ দিন?

Advertisement

মধুগড়ে একটি বহুতল নির্মাণের কাজ চলছে। তাতেই পাইলিং-এর জন্য কুয়ো খোঁড়ার কাজ করতে অন্যদের সঙ্গে এসেছিলেন নিউ ব্যারাকপুর-গঙ্গানগরের বাসিন্দা অমর। দড়ি বাঁধা একটি বালতি নিয়ে নীচে নামেন তিনি। তাঁর কোমরে কোনও দড়ি বাঁধা ছিল না। শ্রমিকেরা বলেন, তাঁদের কুয়ো খোঁড়ার এটাই রেওয়াজ। এক-একটি কুয়োর গভীরতা ২৫-৩০ ফুট। ব্যাস ফুট দুয়েক। বেলা পৌনে ৩টে নাগাদ বারো নম্বর কুয়োয় শেষ দফার খোঁড়ার কাজ চলছিল। হঠাৎই উপর থেকে মাটি ধসে পড়ে। তাতে চাপা পড়ে যান অমর। সঙ্গে থাকা বালতির দড়ি ধরে বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেটিও ছিঁড়ে যায়। দড়ির সাহায্যে নিজেকে কিছু ক্ষণ ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টাও শেষ হয়ে যায় তাঁর।

বিকাশ মুখোপাধ্যায় নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “মাটি চাপা পড়েও কোনও রকমে ঘাড় তুলে ওঠার চেষ্টা করছিলেন ওই শ্রমিক। পারেননি।” বেগতিক দেখে অমরকে উদ্ধার করতে নীচে নামেন প্রহ্লাদ পাল নামে অন্য এক শ্রমিক। তিনি অমরের হাত ধরে তোলার সময় ফের বালির ধস নামে। আর তাতেই পুরোপুরি চাপা পড়ে যান অমর। প্রহ্লাদেরও হাঁটু পর্যন্ত বালি জমে যায়। উপরে থাকা অন্য মিস্ত্রি ও শ্রমিকেরা কোনও রকমে প্রহ্লাদকে টেনে উপরে তোলেন।

বেলা সাড়ে ৩টে নাগাদ আসে দমকল। তারা ভেবেছিল, জল থেকে কাউকে তুলতে হবে। কিন্তু সরু মুখের কুয়োয় তাদের লোকজন নামতেই পারেননি। খবর যায় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরে। কিন্তু জেলায় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কোনও দল নেই। তখন যোগাযোগ করা হয় কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা দলের সঙ্গে। বিকেল ৫টা নাগাদ কুড়ি জনের বিপর্যয় মোকাবিলা দলটি ঘটনাস্থলে পৌঁছয়।

বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরাও কুয়োয় নামার চেষ্টা করে সফল হননি। ওই দলের তরফে জানানো হয়, কুয়ো থেকে কাউকে উদ্ধারের প্রশিক্ষণই নেই তাদের। এই অবস্থায় অমরের সহকর্মীদেরই নীচে নামিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যায় দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা দল। প্রায় ৩০ ফুট গভীরে মাটি চাপা পড়ে থাকায় অমরকে দেখা যাচ্ছিল না। সাড়াশব্দও মিলছিল না। এর পরে পাশের একটি কুয়ো দিয়ে তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হয়। মাটির নীচে অমরের অবস্থান জানতে ঢোকানো হয় বিশেষ মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা। কিন্তু মাইক্রোফোনেও তাঁর সাড়া মেলেনি। ক্যামেরাও বিশেষ কাজ করেনি। বিপর্যয় মোকাবিলা দলের কর্মীরা জানান, পাশের কুয়োটির প্রায় ২৫ ফুট নীচে পৌঁছে গর্ত খোঁড়ার কাজ চলছিল। ওই শ্রমিক কাদামাটিতে গেঁথে যাওয়ায় তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

নীচে নেমে শেষ পর্যন্ত অমরের নাগাল পান তাঁর দু’জন সহকর্মীই। তাঁরা হতচেতন অমরের কোমরে কপিকলের দড়ি বেঁধে তাঁকে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু উপর থেকে কপিকল টান দেওয়া মাত্র অমরের মুখ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। বেশ কয়েক বার চেষ্টা চালিয়েও তাঁকে তোলা যায়নি। তার পরে শুরু হয় দ্বিমুখী প্রয়াস। উপর থেকে কপিকল আর নীচে পাশ থেকে বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে অমরকে বার করার চেষ্টা করেন শ্রমিকেরা। তাতেও কাজ হয়নি। রাত বেড়ে যাওয়ায় শ্রমিকেরা অমরের কোমরে দড়ি বেঁধে দিয়ে নিজেরা উঠে আসেন। উপরে আড়াআড়ি বাঁশ ফেলে তাতে দড়ি বেঁধে টান দিয়ে অমরকে তোলার চেষ্টা হয়। কিন্তু পরপর দু’বার বাঁশ ভেঙে যায়। লোহার পাইপ পেতে তাতে দড়ি বেঁধে অমরকে তোলার চেষ্টাও সফল হয়নি। সেই পাইপও যায় বেঁকে। শেষ রাতে দমকলের তরফে জানানো হয়, পাশে গর্ত খুঁড়ে অমরকে তোলার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা চলছে।

হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রে কুয়োয় পড়ে গিয়ে ৪৯ ঘণ্টা তার ভিতরেই ছিল ছ’বছরের প্রিন্স। পাশে গর্ত খুঁড়ে তাকে উদ্ধার করা হয়েছিল। “ঠিক সময়ে চেষ্টা করলে বাবাকেও হয়তো উদ্ধার করা যেত। মাকে যে কী ভাবে খবরটা দেব, বুঝতে পারছি না,” ক্ষোভের সঙ্গে বললেন অমরের কলেজপড়ুয়া দুই ছেলে অলোক আর জীবন। বিকেল থেকে সারা রাত ঘটনাস্থলেই বিষণ্ণ মুখে বসে ছিলেন তাঁরা।

উদ্ধারকাজ দেখতে ভিড় করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কী ভাবে এমনটা ঘটল, পুলিশ সেই ব্যাপারে তাঁদের এবং কুয়ো খুঁড়তে আসা শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। পুলিশি সূত্রের খবর, ওই শ্রমিকেরা সুনীল পাল নামে এক ঠিকাদারের হয়ে কাজ করতে এসেছিলেন। তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সব নিয়মকানুন মেনে কুয়ো খোঁড়া হচ্ছিল কি না এবং শ্রমিকদের উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল কি না, ঠিকাদারকে সেই সব প্রশ্নও করে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ জানান, দুপুরেই অমর এক বার কুয়োয় নেমে উঠে এসে বলেছিলেন, নীচে বালি খুব বেশি। আর খোঁড়াখুঁড়ি করা সম্ভব নয়।

কিন্তু কুয়ো খোঁড়ার ঠিকাদারদের তরফে চাপাচাপি করে তাঁকে ফের নামানো হয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement