তখনও সন্ধ্যার পর কলকাতায় গ্যাসের বাতি জ্বলে আর ছাপার কাজ হয় কাঠের ব্লকে। বিডন স্ট্রিটের পোস্টমাস্টার খুন হলেন। পরের দিন দৈনিক পত্রিকায় সেই মৃত ব্যক্তির ছবি ছাপা হবে বলে এক কাঠখোদাই শিল্পী সারা রাত মৃত ব্যক্তির সামনে বসে একের পর এক পোর্ট্রেট করে দিলেন কাঠের ব্লকে। লোহার সরু তুলিতে ছবির চরিত্রদের জীবন্ত করে তুলতেন তিনি। ভারতীয় ও অভারতীয় ব্যক্তির চোখের মণির রঙের তারতম্য সাদা-কালো রেখা দিয়েই ফুটিয়ে তুলতে পারতেন তিনি। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার থেকে শুরু করে ‘পি এম বাগচি’-র কিশোরীমোহন বাগচি ছিলেন তাঁর গুণগ্রাহী। কলকাতা শহরে পাঁচখানা বাড়ি করেছিলেন। তবু কাঠখোদাই শিল্পী প্রিয়গোপাল দাসের নাম তলিয়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অতলে।
প্রিয়গোপাল তবু আর্থিক সাফল্য পেয়েছিলেন। কিন্তু মহম্মদ সাবিরের মতো গুণী কাঠখোদাই শিল্পীর অনাহারক্লিষ্ট জীবন বন্ডেল গেট অঞ্চলে এক ঘুপচি অন্ধকার, ইট বার-করা ঘরে শেষ হয়ে যায়— ক্ষয়রোগে।
উনিশ শতকে বটতলার বইয়ের ব্যবসার হাত ধরেই শুরু হয় কাঠখোদাই ছবি ছাপা। ঘরের দেওয়ালে টাঙানোর জন্য আলাদা ছাপা হওয়া বড় কাঠখোদাই ছবি কিংবা বইয়ের জন্য ছবি আঁকা বা খোদাই করা ছাড়াও, শিল্পীরা হ্যান্ডবিল-পোস্টারের জন্য বড় বড় কাঠের হরফ কাটা, কাঠখোদাই করে ব্লক তৈরি, বিজ্ঞাপনের নকশা, পণ্যের লেবেল, বাহারি অলঙ্করণ— সবই কাটতেন। তবে পঞ্জিকা আর বইয়ের ছবি বাদে বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অঙ্গ এই শিল্পের সূর্য পাটে গেল বিশ শতকের সূর্যোদয়ের আগেই। বহু খোদাইশিল্পী লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন শাড়ির ব্লক, মিষ্টির ছাঁচ তৈরি করে। কিন্তু বেশির ভাগই অন্য পেশায় সরে গিয়েছেন বাঁচার তাগিদে।
শিল্পী-গবেষক অসিত পাল দীর্ঘ দিন কাজ করছেন কাঠখোদাই ছবি নিয়ে। এই বিষয়ে একাধিক প্রামাণ্য বই তাঁর, যেমন উডকাট প্রিন্টস অব নাইনটিনথ সেঞ্চুরি ক্যালকাটা বা উনিশ শতকের কাঠ খোদাই শিল্পী প্রিয়গোপাল দাস। সেই অনুসন্ধানের গল্প অনেকটাই অজানা আমাদের। তার মধ্যে যেমন হারিয়ে যাওয়া শিল্পীর পরিচয় খুঁজে বার করা আছে, তেমনই আছে শতাব্দীর বিস্মরণ সরিয়ে ভুলে যাওয়া কাঠের ব্লকের নিদর্শন উদ্ধারের কথা। আছে খোদাইয়ের কাজ ছেড়ে কোনও শিল্পীর মুড়ি ভেজে পেট চালানোর করুণ সত্য।
অতলে তলিয়ে যাওয়ার আগে কাঠখোদাই শিল্পের হালহদিস যতটা সম্ভব সংরক্ষণের লক্ষ্যে এ বার তিনি লিখেছেন তাঁর যাত্রাপথের বিবরণ। নতুন বই বটতলার ডায়েরি প্রকাশ করছে ‘মায়া বুকস’। আনুষ্ঠানিক প্রকাশ আগামী ২৪ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কসবা রাজডাঙার মায়া আর্ট স্পেস-এ, তপতী গুহঠাকুরতা ও লেখক-সহ বিশিষ্টজনদের উপস্থিতিতে। উপরের ছবিগুলি বই থেকে নেওয়া: বাঁ দিক থেকে কাঠখোদাই ছবির ‘বাবু’, শীতল কুমার দাসের সন্দেশের ছাঁচ থেকে ছাপ-তোলা ত্রিমাত্রিক সন্দেশ, কাঁসারিপাড়ার লিথো-চিত্র হুঁকো-সুন্দরী।
স্মরণার্ঘ্য
রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদর্শ শিক্ষক ছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার (ছবি)। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পরে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে গানের পাঠ নিয়েছেন, নিখুঁত স্বরলিপিতে ছিলেন দক্ষ। কিন্তু গায়ক হতে চাননি, গানের শিক্ষকতার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সঙ্গীত ভবনের ভার হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে শিক্ষকতায় প্রণোদিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথও। আচার্য শৈলজারঞ্জনের হাতে গড়া শিষ্য-শিষ্যাদের কণ্ঠের গানেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সগৌরব স্ফুরণ ঘটে কবির জন্মশতবর্ষে, সেই উত্তরাধিকার বহতা আজও। এ বছর তাঁর জন্মের ১২৫ বছর উদ্যাপনের সূচনা (জন্ম ১৯০০), জন্মদিন চলে গেল গতকাল। রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা প্রতিষ্ঠান ‘কথা ও সুর’ আগামী ২৪ জুলাই শ্রদ্ধা জানাবে তাঁকে। উত্তর কলকাতার বীরেন্দ্র মঞ্চে সন্ধ্যা ৬.১৫ থেকে অনুষ্ঠান, শৈলজারঞ্জনের রবীন্দ্রসঙ্গীত-ভাবনা অবলম্বনে গীতি আলেখ্য ‘তাঁর আপন গান’; দ্বিতীয়ার্ধে ‘দুঃখ আমার ঘরের জিনিস’ শিরোনামে নির্বাচিত রবীন্দ্রগান শোনাবেন সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়।
অন্তরে বাহিরে
কুড়ি বছর বয়সে বৌ-ঠাকুরাণীর হাট উপন্যাসের গান ‘আজ তোমারে দেখতে এলেম’ পিলু রাগে বেঁধেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আটচল্লিশে পৌঁছে প্রায়শ্চিত্ত নাটকে সে গানই বাঁধলেন ভৈরবীতে। একই গানের পাঠান্তর ছন্দান্তর সুরান্তর বহু বার ঘটিয়েছেন কবি। এমন কিছু গান নিয়েই বেহালা যাদুবিন্দুর উদ্যোগ ‘রূপান্তরী’, শোনা যাবে আজ, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্কের বিবেকানন্দ হল-এ বিকেল ৫টা থেকে। অন্য দিকে, এ বছরটি রবীন্দ্রনাথের চিন ভ্রমণের শতবর্ষ পূর্তির বছর। বিশ্বভারতীর দুই শিক্ষক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আলোচনা করবেন এই সফরের পরিপ্রেক্ষিত ও গুরুত্ব নিয়ে, কালীঘাট পার্কে রবীন্দ্রচর্চা ভবনে ২৬ জুলাই সন্ধ্যা ৬টায়।
সেই সময়
চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত ভাবনাচিন্তা ছিল নাগরিক প্রতিভাসে বিম্বিত। পরে এলেন বিশ্বভারতীতে: ইতিহাসের অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান। ১৯৭৩-১৯৮৩ অধ্যাপক অশীন দাশগুপ্তের জীবনের সদা সৃষ্টিশীল এক পর্ব, মননের বিবর্তন ও সম্প্রসারণেরও ঘটনাবহুল সময়। তাঁর সেই সময়কার ছাত্র ভাস্করজ্যোতি বসু, গবেষণা করেছেন ওঁর কাছে, পরে বিশ্বভারতীর শিক্ষক হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ প্রতি বছর এশিয়াটিক সোসাইটি কলকাতার সহযোগিতায় ‘অশীন দাশগুপ্ত স্মারক বক্তৃতা’র আয়োজন করে, এ বার তার ছাব্বিশ বছর। ২২ জুলাই সোসাইটির বিদ্যাসাগর হল-এ বিকেল ৪টেয় ভাস্করজ্যোতি বসু বলবেন ‘অধ্যাপক অশীন দাশগুপ্ত ও শান্তিনিকেতনে ইতিহাস চর্চা, ১৯৭৩-১৯৮৩’ নিয়ে।
কবির স্মরণে
ভাস্কর চক্রবর্তীর প্রথম কবিতাবই শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা প্রকাশিত ১৯৭১-এ। কলকাতা তার আগেই পড়েছে অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে, হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান, নিহিত পাতালছায়া, নিষিদ্ধ কোজাগরী, আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি। ভাস্কর এলেন জোরালো, আত্মমুখী কবিতা নিয়ে: মধ্যবিত্তের গ্লানি, অসুখ, মনখারাপ, কলকাতার রাতদিন উঠে এল তাঁর কবিতায়। কেমন সেই শব্দ-নৈঃশব্দ্যের জ্যামিতি? আগামী ২৩ জুলাই, কবির প্রয়াণদিনে ‘ভাস্কর চক্রবর্তী স্মারক বক্তৃতা’য় ফিরে দেখবেন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়। কবির নামাঙ্কিত স্মৃতি পুরস্কার পাবেন হিন্দোল ভট্টাচার্য, প্রশান্ত মাজীর সম্পাদনায় প্রকাশ পাবে বই প্রিয় সুব্রত প্রিয় ভাস্কর। বাসবী চক্রবর্তী, প্রতিবিম্ব ও ঋক প্রকাশনীর আয়োজন, রামমোহন লাইব্রেরির রায়া দেবনাথ মেমোরিয়াল হল-এ, সন্ধ্যা ৬টায়।
মুদ্রা চর্চা
১৭৯০-এর কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির প্রকাশনায় রোমান মুদ্রা নিয়ে প্রথম আলোচনা প্রকাশ পায়। তার পর থেকে শহরের দেশি-বিদেশি উৎসাহীদের উদ্যোগে এগিয়েছে মুদ্রা নিয়ে গবেষণা। মুদ্রা-গবেষণা ইতিহাস সমাজ অর্থনীতির জ্ঞানেরও উৎস; মুদ্রা সংগ্রহ ও চর্চা করেন বহু মানুষ। অসাধু কারবারের ফাঁদও পাতে অনেকে, ক্ষতি হয় সংগ্রাহকদের। মুদ্রা সম্পর্কে যথার্থ তথ্যই মুশকিল আসান, এই ভাবনা থেকে ‘নিউমিসম্যাটিক সোসাইটি অব ক্যালকাটা’ সংগ্রাহকদের সচেতন করতে উদ্যোগ করেছে প্রদর্শনী ‘কলকাতা কয়েন ফেস্ট ২০২৪’। থাকবেন মুদ্রা বিশেষজ্ঞরা, ভারত সরকারের টাঁকশাল বিভাগ, মুদ্রা নিলাম সংস্থা। বালিগঞ্জ পার্কে হলদিরাম ব্যাঙ্কোয়েট হলের তৃতীয় তলে, ২৬-২৮ জুলাই, ১১টা-৬টা।
উৎসবময়
অরুণ মুখোপাধ্যায় রচিত-নির্দেশিত মারীচ সংবাদ-এর (ছবিতে ১৯৮৮ সালে এ নাটকের একটি অভিনয়ের দৃশ্য) শেষ অভিনয় ২২ জুলাই বিড়লা সভাগারে সন্ধ্যা ৭টায়। সন্ধ্যা ৬টা থেকেই মঞ্চে থাকবেন অঞ্জন দত্ত ব্রাত্য বসু সুমন মুখোপাধ্যায় দেবেশ চট্টোপাধ্যায় অর্পিতা ঘোষ প্রমুখ, অভিনেতা-নির্দেশক সুজন নীল মুখোপাধ্যায়ের ৫০তম জন্মদিন পালনে। “ওটা উপলক্ষ মাত্র, এখনকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু নাট্যপ্রযোজনা দেখাতেই এ আয়োজন,” বললেন নীল। তাঁর লেখা বইও বেরোবে সে দিন। চেতনা মধুসূদন মঞ্চে ২৩-২৮ জুলাই আয়োজন করেছে নাট্যোৎসব, আছে বিনোদিনী অপেরা, ডন/তাকে ভালো লাগে, মহাত্মা বনাম গান্ধী, ব্রেন, ঘাসীরাম কোতোয়াল, হারানের নাতজামাই, হিবিজিবি বাহিনী ও জগন্নাথ (এরও শেষ অভিনয়)। দেখানো হবে বড়-পর্দা ও ওটিটি-তে নীল অভিনীত বুমেরাং, ঘেঁটে ঘ, তিন ইয়ারি কথা, ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা ইত্যাদি, ২৯-৩০ জুলাই নন্দন ৩-এ।
এত সুর আর
অভিমান ছবির সেই সংলাপ মনে পড়ে? অভিনেতা ডেভিড বলছেন, সুবীর কুমারের (অমিতাভ বচ্চন) তুলনায় তাঁর স্ত্রী উমার (জয়া ভাদুড়ি) গলা বেশি আবেদনময়। সিনেমায় এই ‘সুবীর’ নামকরণ কিন্তু বাংলা গানের রোম্যান্টিক কণ্ঠ সুবীর সেনের (ছবি) কথা ভেবেই। গায়ক-নায়ক হওয়ার প্রস্তাব অবশ্য পত্রপাঠ ফেরত পাঠিয়েছিলেন সুধীন দাশগুপ্তের মানসপুত্র। ‘ওই উজ্জ্বল দিন’ থেকে শুরু করে ‘নয় থাকলে আরও কিছুক্ষণ’ হয়ে ‘এত সুর আর এত গান’-এর কয়েক দশকের পরিক্রমায়, বাংলা ও হিন্দি ছবির গানে সুবীর সেন আজও এক দ্যুতিময় কণ্ঠের উজ্জ্বল স্মৃতি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও রবীন্দ্রগানেও পারদর্শী এই শিল্পীর নব্বইতম জন্মদিন আগামী ২৪ জুলাই, উদ্যাপন করবেন ‘কর্ডস অ্যান্ড রিদম’ এবং ‘হংসধ্বনি’র সদস্যরা। আগামী বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টায়, বিড়লা অ্যাকাডেমি অব আর্ট অ্যান্ড কালচার প্রেক্ষাগৃহে।
বই ঘিরে
প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতি বিভাগ বললেই যে ক’জন প্রবাদপ্রতিম শিক্ষকের কথা মনে পড়ে, মিহির রক্ষিত তাঁদের অন্যতম। জন্মস্থান চট্টগ্রাম থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ-কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পাঠ শেষ করে লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ পিএইচ ডি; দীর্ঘ দিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা— অষ্টাশি বছরের অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করে মিহিরবাবু লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথা: দ্য ভিলেজ, দ্য টাউন অ্যান্ড দ্য মেট্রোপলিস: মেমোয়ার্স অব আ সোশ্যাল সায়েন্টিস্ট। আজ ২০ জুলাই বিকেল ৫টায় কলেজ স্কোয়ারের ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল-এ বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ, অনুষ্টুপ পত্রিকা ও প্রকাশনার উদ্যোগে। প্রকাশ পাবে আরও একাধিক বই, অনুষ্টুপ পত্রিকার প্রাক্-শারদীয় ২০২৪ দলিত বিষয়ক বিশেষ সংখ্যাও। এই সময়ে দাঁড়িয়ে কেন দলিত ভাবনা জরুরি, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় আলোচনা করবেন সেই প্রসঙ্গে।