রাস্তা থেকে এ ভাবেই চাদরে পেঁচানো অবস্থায় উদ্ধার হয় শম্পা চক্রবর্তীর দেহ(ইনসেটে)। ঘটনাস্থলে ভিড় প্রতিবেশীদের। রয়েছে পুলিশও। রবিবার, বেহালার বাসুদেবপুরে। ছবি: অরুণ লোধ
চাদর দিয়ে পেঁচানো একটি দেহ। চাদরটা আবার বাঁধা নাইলনের দড়ি দিয়ে। বেরিয়ে আছে শুধু দুটো পা। পাশেই পড়ে একটি ট্রলিব্যাগ। সাতসকালে রাস্তায় বেরিয়ে এমন দৃশ্য দেখে চমকে উঠেছিলেন পর্ণশ্রী থানা এলাকার বাসুদেবপুরের কয়েক জন বাসিন্দা। পা দু’টি দেখে বোঝা যাচ্ছিল, দেহটি কোনও মহিলার। ওই বাসিন্দারাই পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এসে চাদর সরাতেই স্থানীয়েরা দেখেন, মৃতদেহটি তাঁদেরই পাড়ার এক মহিলার! তাঁর নাম শম্পা চক্রবর্তী (৪৭)। দেহটি যেখানে পড়েছিল, তার ঠিক পাশের বহুতলেই চারতলার ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি। এই ঘটনায় শম্পার মেয়ে স্নেহা সামুই ও জামাই জয় সামুইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই বহুতলের চারতলার ছাদের ফ্ল্যাটে স্বামী ভূপাল চক্রবর্তীর সঙ্গে থাকতেন শম্পা। ভূপাল পেশায় নিরাপত্তারক্ষী। ওই দম্পতির মেয়ে-জামাইও থাকে তাঁদের সঙ্গে। প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, শম্পার গলায় গভীর ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। ধারালো কিছু দিয়ে তাঁর গলায় আঘাত করা হয়েছে বলে অনুমান পুলিশের। তাদের আরও ধারণা, ট্রলিব্যাগে করে মৃতদেহ পাচারের ছক কষেছিল অভিযুক্তেরা। খুনের সময়ে অবশ্য ভূপাল ছিলেন তাঁর কর্মস্থলে।
এ দিন পুলিশ এসে দেখে, শম্পাদের ফ্ল্যাটের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকেন তদন্তকারীরা। এক পুলিশকর্তার দাবি, জেরায় স্নেহা জানিয়েছে, জয়কে পছন্দ করতেন না তাঁর মা। বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য তিনি জয়ের উপরে চাপ দিতেন বলেও অভিযোগ স্নেহার। তার দাবি, সে কারণেই শাশুড়িকে খুন করার পরিকল্পনা করে জয়। স্নেহা আরও জানিয়েছে, খুনের পরিকল্পনায় সে স্বামীকে সমর্থন করেছিল। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান, প্রথমে শম্পার শ্বাসরোধ করা হয়। এর পরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে বাড়ির আনাজ কাটার ছুরি দিয়ে কাটা হয় নলি।
পুলিশ জানিয়েছে, শম্পাকে খুনের সময়ে তাঁর পোষ্য একটি বেড়াল প্রাণপণে চিৎকার করছিল। জয় সেটির গলায় বেল্ট পেঁচিয়ে মারতে চেষ্টা করে। বেড়ালটি অর্ধমৃত অবস্থায় খাটের তলায় ঢুকেছিল। পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ভূপালদের পরিবার পাড়ায় খুব বেশি মিশত না। এক বাসিন্দা সোমদত্তা মিত্র বলেন, ‘‘ওই ফ্ল্যাট থেকে মাঝেমধ্যেই ঝগড়ার আওয়াজ পেতাম। মা-বাবার অমতে বিয়ে করেছিল স্নেহা। পরে অবশ্য সেই বিয়ে মেনে নেন ভূপালেরা। তার পর থেকে গত এক বছর ধরে স্নেহা ও জয় ওই বাড়িতেই থাকত। তবে বিয়ের পরেও যে মা-বাবার সঙ্গে মেয়ে ও জামাইয়ের বনিবনা হয়নি, তা ঝগড়ার আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারতাম।’’
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শম্পাদের ফ্ল্যাটের উল্টো দিকে একটি বহুতলে এক মহিলা ও তাঁর স্বামী থাকেন। ওই ব্যক্তি পুলিশকে জানিয়েছেন, রবিবার তখন ভোর চারটে। অফিসের কিছু কাজের জন্য তিনি ও তাঁর স্ত্রী সারা রাত জেগেছিলেন। হঠাৎ জোরে কিছু পড়ার শব্দ শুনতে পান তাঁরা। ওই এলাকায় সম্প্রতি চোরের উপদ্রব হয়েছে। তাই চোর এসেছে ভেবে ওই দম্পতি ফ্ল্যাটের বারান্দায় আসেন। তখনই তাঁদের চোখে পড়ে রাস্তায় দুই ছায়ামূর্তিকে। তাঁদের মধ্যে এক জনকে সাইকেল চালিয়ে চলে যেতেও দেখেন তাঁরা। পুরো দৃশ্যটি মোবাইলে ভিডিয়ো করেন ওই মহিলা। পরে ভিডিয়োটি খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পারেন, ওই দু’জন ছিল স্নেহা ও তার স্বামী জয়।
ওই মহিলার স্বামী এ দিন বলেন, ‘‘আমরা ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি, ওরা দু’জন অত ভোরে কী কারণে ফ্ল্যাটের সামনে রাস্তায় ঘুরছে। সকালে উঠে শম্পাকে খুনের খবর জানতে পারি।’’ পুলিশের অনুমান, ভোরে অন্ধকার থাকতে থাকতেই শম্পার দেহ চাদরে মুড়িয়ে সাইকেলের ক্যারিয়ারে চাপিয়ে পাচারের চেষ্টা করছিল স্নেহা ও জয়। কিন্তু কোনও ভাবে দেহটি রাস্তায় পড়ে যাওয়ায় তারা সেটি ফেলে রেখেই চম্পট দেয়।