150 years of Kolkata Tram

দেড়শো বছর পার করেও ‘হেরিটেজ’ তকমা জুটল না শহর কলকাতার অন্যতম অভিজ্ঞানের, কেউ কথা বলেনি

কলকাতার গর্ব, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। কিন্তু জন্মের দেড়শো বছর পরেও ইউনেস্কোর ‘হেরিটেজ’ তকমা পায়নি কলকাতার ট্রাম। কারণ খুঁজল আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:০৩
Share:

কলকাতার ট্রাম হেরিটেজ তবু হেরিটেজ নয়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

প্রেমের গানে শ্রীজাত লিখেছিলেন, ‘চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন।’ তারও অনেক আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘স্বপ্ন’ দেখেছিলেন, ‘রাস্তা চলেচে যত অজগর সাপ, পিঠে তার ট্রামগাড়ি পড়ে ধুপ্‌ ধাপ্‌।’ যে কবি কলকাতার রাস্তায় ট্রামে চাপা পড়ে জীবন হারিয়েছিলেন, সেই জীবনানন্দ দাশও লিখেছেন ‘সারা দিন ট্রাম-বাস’ নামে গোটা একটা কবিতা। এই সে দিন ‘পিকু’ সিনেমায় অভিনয় করতে এসে নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোয় সাইকেল চালালেন অমিতাভ বচ্চন। আরও কত গানে, কবিতায়, সিনেমায়, সাহিত্যে জড়িয়ে কলকাতার ট্রাম। অন্যতম উদাহরণ সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ ছবি। শুরুর কয়েক মিনিট শুধুই ট্রামের তার।

Advertisement

ট্রামের তার দেখিয়ে মহানগর কলকাতার পরিচয় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ। কিন্তু কলকাতার পরিচয় বহনকারী (শুধু পরিচয় নয়, ট্রাম কলকাতার অভিজ্ঞানও। ভারতের আর কোনও শহরে ট্রাম চলে না) সেই ট্রাম এখন যেন ‘ফেয়ারওয়েল’ পাওয়ার অপেক্ষায়। দেড়শো বছর ধরে শহরের ‘ঐতিহ্য’ হয়ে থেকে গেলেও ‘হেরিটেজ’ তকমা জোটেনি তার। আগামী দিনেও জুটবে না বলেই মনে করেন শহরের ট্রামপ্রেমীরা। ট্রামকে শেষ করে দেওয়ার অভিযোগ সিপিএমের। আর রাজ্য সরকারের যা বক্তব্য, তাতে শহরের ‘হেরিটেজ’ হিসাবে ট্রামকে রক্ষা করার সদিচ্ছা থাকলেও দুর্গাপুজোর মতো হেরিটেজ তকমা জোগাড়ের তেমন তাগিদ আপাতত নেই।

অথচ কলকাতার গণপরিবহণ বিষয়ের গবেষক সৌভিক মুখোপাধ্যায়ের দাবি, কলকাতার ট্রামের হেরিটেজ তকমা পাওয়ার মতো সব যোগ্যতাই রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতার ট্রামের হেরিটেজ তকমা পেতে কোনও বাধা নেই। ইউনিসেফের যে সব ধারা রয়েছে, তাতে একটি হচ্ছে চালুর পরে কখনও বন্ধ হয়েছে কি? কলকাতায় সেটা হয়নি। আর একটা বিষয় দেখা হয়। এটা কি শুধুই বিনোদনের না কি সাধারণের উপকারেও লেগেছে? ট্রাম তো দেড়শো বছর ধরে সাধারণকেই পরিষেবা দিয়ে এসেছে। দেখা হয়, প্রযুক্তিগত ভাবে কি একেবারে বদলে গিয়েছে? সেটাও হয়নি কলকাতায়। আসল কারণ হল ট্রামকে হেরিটেজ করার সেই উদ্যোগটাই নেই। তাতেই ট্রামের স্বপ্নভঙ্গের ভয়।’’

Advertisement

পথের ট্রাম সংস্কৃতিতেও। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

ইউনেস্কোর আরও একটি শর্তের কথা জানালেন ‘ক্যালকাটা ট্রাম ইউজ়ার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর দেবাশিস ভট্টাচার্য। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভারতের বিভিন্ন রেল, যেমন সিমলা-কালকা থেকে দার্জিলিঙের টয় ট্রেন হেরিটেজ তকমা পেয়েছে। যে শর্তে তারা ওই তকমা পেয়েছে, তার সবগুলি পূরণ করতে পারলেও ট্রামের ক্ষেত্রে একটি বাধা রয়েছে। তা হল— এর পরিচালনকারী কর্তৃপক্ষকে বলতে হবে, ভবিষ্যতেও পরিষেবা চালু থাকবে। রাজ্য পরিবহণ দফতর সেই নিশ্চয়তা দিয়ে আবেদন করলে তবেই হেরিটেজ তকমা পাওয়া যায়।’’

রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী অবশ্য ট্রাম তুলে দেওয়া হবে না বলেই জানিয়েছেন। দুর্গাপুজোর মতো ট্রামও যাতে হেরিটেজ তকমা পায়, তা-ও তিনি চান বলেই জানিয়েছেন। তবে একই সঙ্গে জানিয়েছেন, এখনই তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা নেই পরিবহণ দফতরের। আনন্দবাজার অনলাইনকে স্নেহাশিস বলেন, ‘‘ট্রামকে ফেয়ারওয়েল দেওয়ার কোনও পরিকল্পনাই নেই আমাদের। বরং নতুন একটি হেরিটেজ রুট চালুর কথা ভাবা হচ্ছে। ধর্মতলা থেকে ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি রুট শীঘ্রই শুরু করা হবে। আরও কয়েকটি রুটে নতুন করে ট্রাম চালানো হবে। কিন্তু মেট্রো রেলের কাজ চলার জন্য কিছু সমস্যা রয়েছে।’’ শহরের ‘ঐতিহ্য’ হিসাবে ট্রাম থাকবে জানালেও ট্রামের হেরিটেজ তকমা পাওয়া নিয়ে রাজ্য সরকার কেন ভাবছে না, সে ব্যাপারে অবশ্য কোনও নির্দিষ্ট উত্তর দেননি মন্ত্রী।

ধড় আছে, প্রাণ নেই। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ান ওয়েলার ঘোড়ায় টানা প্রথম মিউনিসিপ্যাল ট্রামওয়ে চলেছিল কলকাতায়। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত। যদিও লোকসানের জেরে ওই বছরেরই ২০ নভেম্বর চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর পরে ১৮৭৯ সালের ক্যালকাটা ট্রামওয়ে কোম্পানি ও কর্পোরেশনের মধ্যেকার চুক্তি অনুযায়ী ১৮৮০ সালের ২৭ নভেম্বর রাজপথে ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলাচল শুরু হয়। কিন্তু পশুপ্রেমীদের তরফে অভিযোগ আসে। কলকাতার গরমের সঙ্গে বিদেশি ঘোড়াগুলির মানিয়ে না-নিতে পারার অক্ষমতাও কারণ হয়ে ওঠে। তবে বিদ্যুৎচালিত ট্রাম চলাচল পর্যন্ত টিকে ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম। কলকাতায় প্রথম স্টিমচালিত ট্রাম আসে ১৮৮২ সালে। চৌরঙ্গি ও খিদিরপুর রুটে। ১৯০২ সাল নাগাদ ঘোড়ায় টানা ট্রাম একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। তখনই বিদ্যুৎচালিত ট্রাম চলাচল শুরু হয়। যা এশিয়ায় প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা।

সেই পরিষেবা এখনও চলছে। তবে মাত্র দু’টি রুটে। বালিগঞ্জ থেকে টালিগঞ্জ এবং ধর্মতলা থেকে গড়িয়াহাট। বছর দশেক আগেও শহরে ৩৭টি ট্রামের রুট ছিল। বন্ধ হয়ে থাকা রুটগুলিতে দুর্ঘটনা এড়াতে এখন লাইনের উপর পিচের আস্তরণ দেওয়া হয়েছে। তবে লাইন বেঁচে থাকলেও ট্রাম চলে না শহরের প্রাচীনতম ৩৬ নম্বর রুটে— ধর্মতলা থেকে খিদিরপুর। আমপানের সময় গাছ ভেঙে তার ছিঁড়ে যাওয়ায় বন্ধ হয় যাত্রা। আর চালু হয়নি। কলকাতার ট্রাম হেরিটেজ তকমা না পাওয়ার জন্য সেটিও একটা বড় কারণ হতে পারে। যদিও গবেষক শৌভিকের দাবি, ‘‘প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাময়িক বন্ধ হয়ে যাওয়া হেরিটেজ তকমা পাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালু হওয়া দরকার। বেশি দিন বন্ধ থাকাটা ঠিক নয়।’’

সে একটা সময় ছিল। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

পরিবহণ মন্ত্রী স্নেহাশিস অবশ্য জানিয়েছেন, খুব তাড়াতাড়ি ওই রুটটি চালু করার চেষ্টা হবে। তবে এর পিছনে অন্য কারণ দেখছেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। বাম আমলে কেন ট্রামের হেরিটেজ তকমার জন্য আবেদন করা হয়নি, সে উত্তর এড়িয়ে সেলিম বলেন, ‘‘যানজট বা কম গতির অভিযোগ তো এই রুটের ক্ষেত্রে খাটে না। সুতরাং এই রুট চালু করা উচিত। এর পিছনে দুর্নীতি রয়েছে। তার ছিঁড়ে যাওয়ার জন্য কোনও রুট বন্ধ হতে পারে না। তামার তারই চুরি হয়ে গিয়েছে! কিন্তু কোনও তদন্ত হয়নি। সেটা ধামাচাপা দিতেই লাইনটা তুলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।’’

রাজনৈতিক লড়াই দূরে সরিয়ে রেখেও কলকাতার ট্রাম যে বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে, সে কথা শোনালেন ‘ট্রামপ্রেমী’ শৌভিক। তিনি বলেন, জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘কয়েকটি আদিম সর্পিণীর সহোদরার মতো/ এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে/পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে বিষাক্ত বিষাদ স্পর্শ/ অনুভব করে হাঁটছি আমি।’ অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় বারবার এসেছে ট্রাম। ভোরের ট্রাম বা শেষ ট্রাম নিয়ে কম রোম্যান্টিকতা ছিল না বাঙালির। সব বাহন ঘুমিয়ে থাকার সময় প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াদের গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে দিত ট্রাম।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এত ভালবাসার, এত গর্বের ট্রাম হেরিটেজ হতে পারবে না?’’

দুর্গাপুজো হেরিটেজ তকমা পাওয়ার পর বিজেপি দাবি করেছিল, এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগ ছিল। ট্রামের জন্য রাজ্যের নতুন বিরোধী দল বিজেপির ভাবনা কী? সাংসদ তথা রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক লকেট চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এ ভাবে কখনও ভাবা হয়নি। তবে আমি কথা দিলাম, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে কিছু করা যায় কি না সে ব্যাপারে খোঁজ নেব। খুব তাড়াতাড়ি কেন্দ্রীয় সংস্কৃতী মন্ত্রী মীনাক্ষি লেখির সঙ্গে আমি নিজে কথা বলব। প্রয়োজনীয় চিঠিও দেব।’’

ক’দিন আগেই বিধানসভায় কলকাতার ট্রামকে বাঁচিয়ে রাখার আর্জি জানিয়েছেন স্বয়ং স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। সে আর্জি মানবেন বলে কথা দিয়েছেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। ট্রামকে বাঁচিয়ে রাখার কথা বলেছেন মন্ত্রী স্নেহাশিসও। কেন্দ্রীয় উদ্যোগের জন্য চেষ্টার আশ্বাস দিয়েছেন সাংসদ লকেট। এর পরে কি কলকাতার ট্রাম আশাবাদী থাকবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement