(বাঁ দিক থেকে) অনুষ্টুপ মুখোপাধ্যায়, অর্ণব মুখোপাধ্যায়, তনয়া পাঁজা, সায়ন্তনী ঘোষ হাজরা, স্নিগ্ধা হাজরা এবং পুলস্ত্য আচার্য। শনিবার রাতে ধর্মতলায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
মতপার্থক্য ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই ছিল। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের অন্দরের ‘বিরোধ’ কি এ বার উঁকি দিল বাইরেও? প্রশ্ন উঠল ধর্মতলায় শনিবারের অনশনমঞ্চের সামনে উপস্থিত অনেকের মনে। প্রশ্নটি ছড়াচ্ছে তার পরেও, মঞ্চের পরিসরের বাইরেও। শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় ঘোষণা করা হল, ‘‘আজ থেকেই আমরণ অনশনে বসছি আমরা। আমরা কাজে ফিরছি কিন্তু খাবার খাব না।’’ জানানো হল, অনশনে বসছেন ছ’জন। এবং জানিয়ে দেওয়া হল, ‘‘আজকে যাঁরা অনশনে বসলেন, তাঁদের মধ্যে আরজি করের কেউ নেই।’’ কেন নেই? আন্দোলনের ‘কেন্দ্রভূমি’ আরজি কর। গোটা আন্দোলন চলছে আরজি করের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। সেই আরজি করই অনশনে নেই? তবে কি এত দিন নানা মতের বৈচিত্র বা বিরোধ ধারণ করেও যে আন্দোলন ঐক্যবদ্ধ ছিল, তাতে এ বার প্রকাশ্য ফাটল দেখা দিল? মানছেন না জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁদের কথায়, আরজি করের এই মুহূর্তের পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত। এবং এই সিদ্ধান্ত হয়েছে ঐক্যবদ্ধ ভাবেই।
ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেলের সামনে ত্রিপল টাঙিয়ে অস্থায়ী ভাবে মঞ্চ তৈরি করেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। ‘আমরণ’ অনশনে বসেছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অনুষ্টুপ মুখোপাধ্যায়, স্নিগ্ধা হাজরা, তনয়া পাঁজা, এসএসকেএমের অর্ণব মুখোপাধ্যায়, কেপিসি মেডিক্যাল কলেজের সায়ন্তনী ঘোষ হাজরা এবং এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের পুলস্ত্য আচার্য। গত ৯ অগস্ট যে হাসপাতালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছিল, সেই হাসপাতালের কেউ না থাকলে যে জনমানসে অন্য বার্তা যেতে পারে, তা কি কেউ ভেবে দেখেননি? না কি আরজি কর হাসপাতালের কেউ অনশনে বসতে রাজিই ছিলেন না? প্রশ্ন উঠেছে তেমনও।
জুনিয়র ডাক্তারেরা অবশ্য অনৈক্যের জল্পনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, কারা অনশনে বসবেন, আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সর্বসম্মত ভাবেই সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। প্যান জিবিতে সকলে মিলে এই সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সকলের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরজি করের জুনিয়র ডাক্তার তথা আন্দোলনের অন্যতম মুখ অনিকেত মাহাতো আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘সকলে মিলেই এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম অংশ থ্রেট কালচারের বিরুদ্ধে লড়াই। শনিবার তা নিয়ে আমাদের কলেজ কাউন্সিলের বৈঠক চলছিল। আমরা আরজি করের আন্দোলনকারীরা সেখানেই ছিলাম। আমাদের হাসপাতালে থ্রেট কালচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। সেই কারণে ধর্মতলায় থাকতে পারিনি। আসলে এই আন্দোলনের অনেকগুলি দিক রয়েছে। আমরা আন্দোলনের মধ্যেই আছি।’’
শনিবার রাতে ধর্মতলার মঞ্চে জুনিয়র ডাক্তারেরা। —নিজস্ব চিত্র।
আরজি করের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন, তাতে প্রায় গোড়া থেকেই নানা মত এসেছে থেকেছে গিয়েছে। এই নানা মতের সহাবস্থানের কথা অস্বীকার করেন না জুনিয়র ডাক্তারেররাও। যে কোনও আন্দোলনেই এটি স্বাভাবিক ঘটনা। আর এই আন্দোলন যে হেতু নির্দিষ্ট এক বা একাধিক দলের পরিচালনায় নেই, যে হেতু আন্দোলনের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই হচ্ছে সব জুনিয়র ডাক্তারের সাধারণ সভা (জিবি)-র মধ্যে দিয়ে, তাই মতামতের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এই কারণেই এক একটি প্যান জিবি চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। কর্মবিরতি থেকে শুরু করে আমরণ অনশন— সব ক্ষেত্রেই পক্ষে-বিপক্ষে মতামত থেকেছে এবং রয়েছে।
কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত প্রথমে নিয়েছিলেন আরজি করের জুনিয়র ডাক্তারেরাই। পরে জুনিয়র ডক্টরস’ ফ্রন্টের সদস্য হিসাবে কর্মবিরতিতে যোগ দেন অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারেরাও। কিন্তু সূ্ত্রের খবর, আন্দোলন কোন পথে এগোবে, তা নিয়ে প্রথম থেকেই একাধিক মত ছিল। ছিল বিভাজনও। মুখ্যমন্ত্রীর একাধিক বার কাজে ফেরার অনুরোধ এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরেও কর্মবিরতি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সেই ‘বিরোধ’ আরও প্রকট করেছিল। সরকারের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পর ৪২ দিনের মাথায় কর্মবিরতি আংশিক তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হল, তখনও তার সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারেরা অনেকেই একমত হতে পারেননি। সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে রোগীমৃত্যুকে কেন্দ্র করে অশান্তি এবং জুনিয়র ডাক্তারদের উপর হামলার ঘটনার পর পুনরায় কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অনেকে তাতেও আপত্তি জানিয়েছিলেন। তবে প্রতি ক্ষেত্রেই জেনারেল বডির বৈঠকে অধিকাংশের মতামত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। অনেকেই এ কথা মেনে নিচ্ছেন, এই ধরনের আন্দোলনের ক্ষেত্রে যেখানে সকলের মতামত গুরুত্ব পাচ্ছে, সেখানে বিরোধ এবং বিভাজন স্বাভাবিক। নানা মত পর্যালোচনা করে মন্থনের মাধ্যমেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত উঠে আসে। একে জুনিয়র ডাক্তারদের অনৈক্য বলে দেগে দেওয়া ভুল হবে।
ধর্মতলায় অবস্থান বিক্ষোভ জুনিয়র ডাক্তারদের। ছবি: পিটিআই।
কিন্তু অনশনে আরজি করের না থাকা কি অন্য ইঙ্গিত দিচ্ছে না? মতবিরোধকে প্রকাশ্যে এনে ফেলল না? আরজি করের অনিকেত বলেন, ‘‘যা হচ্ছে, তাতে আমাদের সকলের সমর্থন রয়েছে। আমরা হয়তো এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারিনি। তবে কে বলতে পারে, পরবর্তী সময়ে হয়তো আবার বৈঠকে নতুন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে! তখন হয়তো আমাদের অন্য কোনও ভূমিকায় দেখা যেতে পারে। আমাদের মধ্যে কোনও বিভাজন নেই। সকলের সম্মতি ক্রমেই এই সিদ্ধান্ত।’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তার আর এক অনিকেত। অনিকেত কর। তাঁরও মতে, ‘‘আগেও আমাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আন্দোলন সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্ত আমরা জিবির মাধ্যমে সকলের সঙ্গে কথা বলেই নিয়ে থাকি। অনশনের সিদ্ধান্তও সম্মিলিত ভাবে জিবি থেকেই উঠে এসেছে। অনশনে যাঁরা রাজি হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে থেকে ছ’জনকে আপাতত বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আরজি কর সব সময়েই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের আন্দোলনের সূত্রপাত সেখান থেকেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আরজি করে এখন অনেক কর্মসূচি চলছে। তাই সেখানকার সহকর্মীরা অন্য অনেক কাজে ব্যস্ত। সিবিআই এবং কলেজের তদন্তকারী কমিটির সঙ্গে ওঁদের যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে। থ্রেট কালচার নিয়েও আন্দোলন চলছে। তাই আপাতত অনশনে আরজি করের কাউকে রাখা হয়নি। সবার সম্মতিতেই এই সিদ্ধান্ত।’’
আরজি কর হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার অনিকেত মাহাতো। —ফাইল চিত্র।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তার অনিকেত কর। —ফাইল চিত্র।
আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে জিবিতে আপত্তি তোলেন অনেকেই। তাঁদের যুক্তি ছিল, এই আন্দোলন যেটুকু জয় পেয়েছে তার উপর দাঁড়িয়ে আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে বা অন্য নানা ভাবে সরকারের উপর চাপ তৈরির মাধ্যমে এগোনটাই এই মুহূর্তে সঙ্গত। নইলে তা ঝুঁকির হয়ে উঠবে। উল্টো মতের যুক্তি ছিল, সরকার মৌখিক ভাবে যা বলছে তার উপর ভরসা রাখার কোনও মানে নেই। ন্যূনতম দাবি না-আদায় হওয়া পর্যন্ত যদি চাপ রাখতেই হয়, তবে কর্মবিরতি তোলার পর আমরণ অনশনের মতো পথেই হতে পারে। তবে এর বাইরে আর একটি দাবিও উঠেছে আন্দোলনের মধ্যে। তা হল— আমরণ অনশনের মঞ্চ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে আরও কড়া দাবি তুলে ধরা হোক। অধিকাংশ আন্দোলনকারীই অবশ্য এর সঙ্গে একমত নন।
জুনিয়র ডাক্তারদের সূত্রে খবর, প্যান জিবি বৈঠকে অনশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর যাঁরা এই অনশনে অংশ নিতে ইচ্ছুক, তাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন। তার পর তাঁদের মধ্যে থেকে সর্বসম্মতি ক্রমে ছ’জনকে বেছে নেওয়া হয়েছে। অনশন চালিয়ে নিয়ে যেতে যেতে এঁদের কারও কোনও শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে অন্যরাও কর্মসূচি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে পারেন।