অবহেলা: ডেঙ্গি পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হলেও সচেতনতার হাল ফেরেনি। প্রগতি ময়দান থানার কাছেই ঝোপজঙ্গলে ভরা জায়গায় পড়ে রয়েছে বাজেয়াপ্ত করা একাধিক গাড়ি। শুক্রবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী
করোনা অতিমারির সময়ে অভিযোগ উঠেছিল, আক্রান্ত ও মৃতের তথ্য গোপন করছে রাজ্য। সেই অভিযোগ ছিল করোনা পূর্ববর্তী বছরগুলিতে ডেঙ্গির পরিসংখ্যান নিয়েও। চলতি বছরের ডেঙ্গির মরসুমেও এই অভিযোগ উঠেছে। এ বার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীও একই অভিযোগ তোলায় বিষয়টা ফের সামনে এসেছে। কিন্তু রাজ্যের তরফে তথ্য গোপন করার এই প্রবণতায় কী কী ক্ষতি হতে পারে?
চিকিৎসকদের দাবি, প্রকৃত তথ্য গোপন করার ফলে জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে। যথাযথ তথ্য না জানতে পারায় মানুষ বিভ্রান্ত হন। অথচ, সংক্রমণ সম্পর্কে মানুষের বিভ্রান্তি, সংশয় কাটানোর দায়িত্ব সরকারের— এমনটাই দাবি প্রবীণ চিকিৎসকদের। তাঁরা এটাও জানাচ্ছেন, প্রকৃত তথ্য না পেলে ডেঙ্গিপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে মশার বংশবিস্তার রোধের কাজ ব্যাহত হয়। তাতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণে ঘাটতি হবে। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে জরুরি হল এলাকা, নিজের বাসস্থান ও তার আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা। সেখানে প্রকৃত তথ্য গোপন করায় মানুষ জানতেই পারছেন না তাঁর এলাকার চিত্রটা কী। তা হলে তিনি সচেতন হবেন কী ভাবে?
শুক্রবার কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে এসে মন্ত্রী ভারতী প্রবীণ পওয়ারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জোরালো হচ্ছে সচেতনতার ঘাটতির প্রশ্নটাই। মন্ত্রীর দাবি, ডেঙ্গির কোনও তথ্যই জানাচ্ছে না রাজ্য। তাঁর এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে চিকিৎসকদের একাংশের প্রশ্ন, ‘‘এমন তথ্য গোপন কি চলতেই থাকবে? কিসের স্বার্থে সংক্রমণের তথ্য গোপন করা হচ্ছে?’’
এ দিকে, বিগত পাঁচ বছরের রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছে রাজ্যের চলতি বছরের ডেঙ্গি পরিস্থিতি। ইতিমধ্যেই রাজ্যে মোট সংক্রমিতের সংখ্যা ৫০ হাজার পেরিয়ে গিয়েছে। বেসরকারি সূত্রের খবর, মৃতের সংখ্যা ৮৫ থেকে ৯০ হাজার। চলতি বছরে ডেঙ্গিতে মৃত্যুর সরকারি পরিসংখ্যান এখনও জানানো হয়নি।
চিকিৎসকদের একাংশের মত, চলতি বছরে অগস্টের শেষ থেকে যখন ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছিল, তখন থেকেই স্থানীয় পুরসভা ও স্বাস্থ্য দফতরের চাপে সংক্রমিতের প্রকৃত সংখ্যা বহু ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে আসছে না। অনেক মৃত্যুই ডেঙ্গিতে নয় বলে দাবি করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক এক প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, ‘‘তথ্য গোপনের এই প্রবণতার কারণেই ডেঙ্গি প্রতিরোধে মানুষ সচেতন নন। মানুষ তো ভয়াবহ দিকটা জানতেই পারছেন না।’’
মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস বলেন, ‘‘তথ্য গোপন করা হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। কারণ মানুষ জানছেন না, তাঁরা কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে। ডেঙ্গি প্রতিরোধ রাজনীতির বিষয় নয়। কেন্দ্র বা রাজ্য কেউই মশা আমদানি করছে না। ফলে ডেঙ্গি নির্মূল করতে হলে যৌথ ভাবে কাজ করতে হবে।’’
এ দিনের অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী দাবি করেন, ডেঙ্গি মোকাবিলায় রাজ্যকে সাহায্য করতে প্রস্তুত কেন্দ্র। কিন্তু রাজ্য তথ্য দিচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘‘তথ্য না দিলে সাহায্য করব কী ভাবে?’’ চিকিৎসকদের অনেকেরই দাবি, রাজ্যে এখন ডেঙ্গির যা অবস্থা, তাতে আগামী কয়েক দিনে আরও বাড়বে আক্রান্তের সংখ্যা। সেই বিপর্যয় ঢাকতেই তথ্য জানানো হচ্ছে না।
কোভিডে আক্রান্তের দৈনিক বুলেটিন প্রকাশ করে স্বাস্থ্য দফতর। অথচ ডেঙ্গির ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থাই নেই! ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম’-এর আহ্বায়ক চিকিৎসক পুণ্যব্রত গুণ বলেন, ‘‘ডেঙ্গি এমন একটা রোগ, যা নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার, পুরসভা, পঞ্চায়েত এবং সাধারণ মানুষকেও উদ্যোগী হতে হয়। অথচ সমস্যার প্রকৃত রূপই যদি মানুষ না জানেন, তা হলে সচেতন হবেন কী করে?’’
তবে তথ্য গোপনের বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের ভূমিকা একই বলেও অভিযোগ পুণ্যব্রতের। তাঁর কথায়, ‘‘করোনার সময়ে সরকারি তরফে দেশে মৃতের সংখ্যা যা জানা যাচ্ছিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা ছিল তার ১০ গুণ বেশি মৃত্যু নথিভুক্তই হচ্ছে না। আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যা গোপন করলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সমস্যা হয়।’’
‘সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম’-এর সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসক সজল বিশ্বাস বলেন, ‘‘করোনার সময়ে তথ্য গোপন করা হয়েছে। দীর্ঘ ১০ বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গির তথ্য গোপন করা হচ্ছে। কাজের সদিচ্ছার অভাব ও পরিকাঠামোর ঘাটতি চাপা দিতেই এমনটা হয়।’’
‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য সম্পাদক তথা তৃণমূল সাংসদ চিকিৎসক শান্তনু সেনের আবার দাবি, ‘‘তথ্য গোপন পশ্চিমবঙ্গ সরকার করে না। ৪৫ লক্ষ মানুষ কোভিডে মারা যাওয়ার পরেও, ভারত সরকার তথ্য গোপন করে সাড়ে চার লক্ষ দেখিয়েছিল।’’