প্রতিজ্ঞা: তাঁবু খাটানোর অনুমতি না মিললেও ছেদ পড়েনি পার্ক সার্কাসের আন্দোলনে। একটি নাগরিক মঞ্চের উদ্যোগে বুধবার আন্দোলনকারীদের মধ্যে পিঠে বিলিও করা হয়। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
‘ছাড়’ পায় সকলেই। না চাইতেও ছাড় মেলে আকছার। নাগরিক জীবনযাত্রা থেকে পরিবেশের নানা ক্ষতি হলেও ‘উদারতা’য় খামতি নেই প্রশাসনের।
শহরের পরম্পরার দোহাই! তাই অতিথিজ্ঞানে নানা জনের জন্য সব সময়েই কোল পেতে রাখে এ শহরের রাজপথ। গঙ্গাসাগরের পুণ্যার্থী থেকে শাসক দলের নেতা-কর্মী, উটকো বারোয়ারি পুজো থেকে ধর্মীয় নামগানের উদ্যোক্তা— সকলের জন্য এটাই নিয়ম। সেই নিয়মের নড়চড় ঘটছে পার্ক সার্কাসে। ন’দিন, ন’রাত কেটে গিয়েছে। শহরের একটি পার্কে নাগাড়ে চলতে থাকা প্রতিবাদী অবস্থান গোটা দেশের নজর কাড়লেও হাড় কাঁপানো শীতে অবস্থানকারীদের জন্য একটু সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে দেওয়ার ন্যূনতম উদ্যোগটুকুও এখনও দেখা যায়নি।
প্রতিবাদের জেদ দেখে ‘সাবাশ’ বলছে গোটা দেশ। রোজই ভিড় বাড়ছে পার্ক সার্কাসের মাঠে। নাগাড়ে নজর রাখছে পুলিশও। শুধু কি রাজ্য সরকারেরই চোখে পড়ছে না এত বড় প্রতিবাদী সমাবেশ? বুধবার কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছেন এই অবস্থান সমাবেশের অন্যতম আহ্বায়ক আসমত জামিল ও আরও কয়েক জন। ঠান্ডায় যাতে একটু স্বস্তি মেলে, তার জন্য প্রতিবাদীদের অনুরোধ, মাথার উপরে সামান্য একটু তাঁবুর ব্যবস্থা হোক। কিন্তু অভিযোগ, এখনও পর্যন্ত কেউ ফিরেও তাকাননি প্রতিবাদীদের দিকে। উল্টে কলকাতার পুরকর্তাদের তরফে এখনও গোটা অবস্থান সমাবেশটাই ‘বেআইনি’ বলে দেগে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
আরও পড়ুন: জানলা দিয়ে লাফ, মেডিক্যালে আত্মঘাতী রোগী
এখানেই দানা বাঁধছে প্রশ্ন। এ শহরেই পরিবেশকর্মীদের তুমুল আপত্তি অগ্রাহ্য করে গঙ্গাসাগরের পুণ্যার্থীদের জন্য কলকাতার গঙ্গা লাগোয়া তল্লাটে শিবির গড়ে দিনের পর দিন সাদরে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় রাজ্য সরকার। তা হলে শহরের কয়েক জন প্রতিবাদী নারীর অবস্থানের নৈতিকতাটুকু মানবিক চোখে দেখতে কীসের অসুবিধা? এ শহরেই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের আচরণের প্রতিবাদে রাজ্যের সম্মানের কথা বলে কার্যত কয়েক মিনিটের নোটিসে শহরের প্রাণকেন্দ্রে রাস্তায় বসে প্রতিবাদ জানাতে দ্বিধা করেন না। সেই প্রতিবাদও গোটা দেশের রাজনৈতিক মহলে মর্যাদা পায়। শহরের পুলিশ-প্রশাসন সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদটুকু আগলে রেখে সহায়তাও করতে থাকেন। তা হলে বৈষম্যমূলক একটি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কেন ব্রাত্য রাজ্যের চোখে? বিশেষত, কেন্দ্রীয় আইনের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদের সঙ্গে যখন পুরোপুরি সমব্যথী বলে নিজেকে দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী? এখনও পর্যন্ত এই প্রশ্নগুলির সদুত্তর মেলেনি।
আরও পড়ুন: নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কারখানায় ট্রাক, আহত পাঁচ
তবে মাঠে অবস্থানকারী প্রতিবাদীরাই শুধু নন, নাগরিক সমাজের তরফেও পার্ক সার্কাসের অবস্থানকারীদের সাহায্যের দাবি জোরালো হচ্ছে। বুধবার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির তরফেও কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমারকে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। তাতে প্রতিবাদীদের জন্য মাথার উপরে ছাউনি এবং পরিবেশবান্ধব শৌচালয়ের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা হয়েছে। অবস্থানরত মহিলাদের অনেকেই অসুস্থ। যে কোনও শৌচাগার ব্যবহার থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন তাঁরা। ওই সংগঠনের দাবি, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অপেক্ষার পরে পুরকর্তার দেখা মেলে। তবে পুরকর্তারা এখনও পর্যন্ত কোনও সদর্থক আশ্বাস দিয়ে উঠতে পারেননি। দেবাশিসবাবু এ দিন বলেন, ‘‘ওই সমাবেশের জন্য অনুমতি নেওয়া হয়নি। ওঁদের বিষয়ে আমি কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। মেয়রকে বিষয়টি জানাব।’’ প্রতিবাদীদের তরফে আসমত জামিল অবশ্য বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ভাল ব্যবহার করেছেন। আমরা শুধু বলেছি, তাঁবু লাগানোর অনুমতি দিন। আমরাই ব্যবস্থা করে নেব। দিদি (মমতা) বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন।’’
নয়া নাগরিকত্ব আইনে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দেশে কলকাতার প্রতিবাদের মুখ এখন পার্ক সার্কাসই। কিন্তু খোদ পুরকর্তাদের চোখে প্রতিবাদীরা কার্যত ‘অনুপ্রবেশকারী’ হয়ে রয়েছেন।