কুকুর নিয়ে তদন্ত। মঙ্গলবার, নেতাজিনগরে। নিজস্ব চিত্র
শহরের বুকে খুন হচ্ছেন একের পর এক বয়স্ক নাগরিক। চলতি বছরে এ নিয়ে চারটি ঘটনায় মৃত্যু হল পাঁচ জন প্রবীণ-প্রবীণার। এ বার খুন হয়েছেন নেতাজিনগর থানা এলাকার এক প্রৌঢ় দম্পতি। মঙ্গলবার নেতাজিনগরের অশোক অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় দিলীপ মুখোপাধ্যায় ও স্বপ্না মুখোপাধ্যায়ের দেহ।
ঘটনার তদন্তে নেমে প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান, লুটপাটের উদ্দেশ্যেই খুন হয়েছেন মুখোপাধ্যায় দম্পতি। ঠিক যে ভাবে এক সপ্তাহ আগে খুন হয়েছিলেন বেহালার শিশিরবাগানের শুভ্রা ঘোষদস্তিদার। বেহালার খুনের তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, আগের দিনই ওই বাড়ির রঙের মিস্ত্রি এক কাঠের মিস্ত্রিকে নিয়ে এসেছিল শুভ্রাদেবীর ঘরে কাঠের কাজ করানোর জন্য। এর পরে পুলিশের জালে ধরা পড়ে সেই কাঠের মিস্ত্রি। যদিও মূল অভিযুক্ত এখনও অধরা। তারই মাঝে খুন হয়ে গেলেন নেতাজিনগরের দম্পতি। এর আগে গত ৬ জুন কড়েয়ার বাসিন্দা বিশ্বজিৎ বসুকে খুনের কিনারাও এখনও হয়নি। এমনকি, ওই খুনের উদ্দেশ্য নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। দু’টি ক্ষেত্রেই মূল অভিযুক্তকে ধরা যায়নি। তবে লেক থানার বৃদ্ধা শ্যামলী ঘোষের খুনের অবশ্য কিনারা করে ফেলেছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা।
এ দিকে, বেহালার খুনের পিছনে লুটের উদ্দেশ্য থাকলেও লেক থানার বৃদ্ধা শ্যামলীদেবীকে খুন করা হয়েছিল তাঁর ফ্ল্যাট হাতানোর জন্য। তবে প্রতিটি খুনের ক্ষেত্রেই ‘টার্গেট’ হচ্ছেন বয়স্ক নাগরিকেরা। বিশেষ করে একাকী বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ারা।
কিন্তু আততায়ীরা কেন বয়স্ক লোকজনকেই বাছাই করছে?
এক পুলিশকর্তার কথায়, শহরের বেশির ভাগ বয়স্ক নাগরিকই একা থাকেন। সব ক্ষেত্রেই তাঁরা নির্ভর হয়ে পড়ছেন অন্যের উপরে। তা ছাড়া, অনেক সময়েই বাড়িতে কেউ এলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সাতপাঁচ না ভেবে ব্যক্তিগত অনেক তথ্য বলে ফেলছেন তাঁদের। যেমনটা হয়েছে নেতাজিনগরের ঘটনায়। পুলিশ ওই ঘটনায় বাড়ির পরিচারিকার সঙ্গে কথা বলে জেনেছে, এক সপ্তাহ আগেই বাড়ির ভিতরে রঙের কাজ হয়েছে। এক সময়ে দিলীপবাবু নিজে রং আর রাসায়নিকের ব্যবসা করায় ওই মিস্ত্রিদের সঙ্গে খোলাখুলি অনেক কথা বলতেন। এমনকি, তাঁদের সামনেই আলমারি খুলে টাকা বার করে দিতেন। পুলিশের অনুমান, দিলীপবাবু ও স্বপ্নাদেবীর দু’টি ঘরে ১১টি আলমারি দেখে ও সেখান থেকে টাকা বার করতে দেখেই আততায়ীদের ধারণা হয়, মুখোপাধ্যায় পরিবারের প্রচুর টাকাপয়সা রয়েছে।
শুধু তা-ই নয়। গত কয়েক বছরে একাধিক বয়স্ক নাগরিকের খুনের তদন্তে দেখা গিয়েছে, কোনও না কোনও মিস্ত্রিই কাজ করতে এসে বাড়ির কোথায় কী রয়েছে, তা দেখে নিয়েছে। পরে সেই পরিচয়ের সূত্রেই ওই বাড়িতে এসে দরজা খুলিয়ে বাড়ির মালিক কিংবা মালকিনকে খুন করে টাকা-গয়না লুট করে নিয়ে গিয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, নেতাজিনগরের ক্ষেত্রে দরজা খোলার পরেই খুন হন স্বপ্নাদেবী, পরে মারা হয় দিলীপবাবুকে। যা দেখে পুলিশের অনুমান, এই ঘটনার ক্ষেত্রেও আততায়ীরা পূর্ব-পরিচিত ছিল। বিভিন্ন ঘটনায় বাড়িতে কাজ করে যাওয়া মিস্ত্রিরা খুনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ায় চিন্তা বেড়েছে গোয়েন্দাদের।
বার্ধক্যবিজ্ঞান বিশারদ ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘খাবার-পোশাক-বাসস্থান ছাড়া নিরাপত্তা প্রবীণদের জন্য সব থেকে জরুরি। এটা প্রযুক্তির যুগ। সিসি ক্যামেরা বা চটজলদি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকলে হয়তো এমন অপরাধ ঠেকানো যেত।’’