অদম্য: পুরকর্মীরা বেআইনি বহুতলের ছাদ ফুটো করে দেওয়ার পরেও সারাই করে ফের চলছে নির্মাণকাজ। তিলজলা প্লেস এলাকায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
কোথাও নির্মাণ-বিধি না মেনেই চারটি স্তম্ভের উপরে তুলে দেওয়া হয়েছে চারতলা বাড়ি। কোথাও দোতলা পর্যন্ত অনুমতি থাকলেও বিপজ্জনক ভাবে উঠেছে বহুতল। কোথাও আবার এমন ভাবে নির্মাণকাজ হয়েছে যে, কয়েক দিনেই একটি বহুতল পাশের বহুতলের গায়ে হেলে পড়েছে! এমন সব বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে পুরসভা প্রায়ই অভিযানে নামে বলে খবর। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে এমন বহুতলের ছাদ ফুটো করেও দিয়ে আসেন পুরকর্মীরা। কিন্তু ওই পর্যন্তই। অভিযোগ, ‘তাপ্পি ঢালাই’ করে ফুটো মেরামতের পরে সেই বাড়িই ফের বিক্রি করে দেন প্রোমোটারেরা! মোটা টাকায় এমন ফ্ল্যাট কিনেও ফেলেন অনেকে।
গার্ডেনরিচে নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে পড়ে দশ জনের মৃত্যুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শহরের বেআইনি নির্মাণ ঘিরে এমন বহু অভিযোগ সামনে আসছে। পুরকর্মীদের বড় অংশের দাবি, গার্ডেনরিচের ঘটনায় পুরপ্রতিনিধি, বরো চেয়ারম্যানের পরিবর্তে পুরকর্মীদের একাংশের উপরে দায় চাপানোর চেষ্টা হলেও আদতে এমন বাড়ির তালিকা নিয়ে তাঁদের দিনের পর দিন নিরুপায় হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।
এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘আমরা গিয়ে ড্রিল করে ছাদ ফুটো করে নামিয়ে দিয়ে আসছি। কিন্তু তার কয়েক মাসের মধ্যেই সেই ঠিকানায় বেআইনি নির্মাণ ফের শুরু হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ আসছে। আমরা গিয়ে দেখছি, ফুটো করে দেওয়া ছাদের অংশটুকু তাপ্পি দেওয়ার মতো করে ঢালাই করে নেওয়া হয়েছে। বাইরে থেকে যাতে বোঝা না যায়, তাই ওই জায়গায় ইট-সুরকি ফেলে রাখা হয়েছে। নীচে গিয়ে ফ্ল্যাটের ভিতর থেকে দেখলেও বোঝার উপায় নেই। তাপ্পির উপরে এমন ভাবে প্লাস্টার করা হচ্ছে যে, বোঝাই যাচ্ছে না, ওই অংশটি ভাঙা হয়েছিল। আমাদের কর্মীরা পরে আর ব্যবস্থা নিতে ঢুকতেও পারছেন না। থানায় গেলেও বলা হচ্ছে, স্থানীয় পুরপ্রতিনিধিই নাকি মেরামত করে নেওয়ার ছাড়পত্র দিয়েছেন!’’ পুরকর্তাদের বড় অংশের অভিযোগ, পুরপ্রতিনিধিদের অনেকেই এর পরে কেন তাঁদের না জানিয়ে ওই এলাকায় ঢুকে বাড়ি ভাঙা হয়েছে, তা নিয়ে উপর মহলে নালিশ করছেন।
এমনই একটি বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেল তিলজলা প্লেসে। সেখানকার ১৩/১ নম্বর বাড়িটিতে বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন পুরকর্মীরা। বেআইনি ভাবে তৈরি ওই বহুতলের ছাদে বেশ কয়েকটি ফুটো করে দিয়ে আসেন তাঁরা। এর পরে সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ফুটো করা অংশে তাপ্পি মেরে ঢালাই করে দেওয়া হয়েছে। উপরে ইট-সুরকির মিশ্রণ ছড়ানো। নীচে কাজ করছেন নির্মাণকর্মীরা। সেখানকার এক ব্যক্তি নিজেকে নির্মাণ ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘‘সমস্ত ফ্ল্যাট বিক্রি হবে। পুরসভা লোক দেখানোর মতো করে কিছুটা ভেঙে দিয়ে গিয়েছে। আমাদের কাছে নির্দেশ আছে, পুরসভার লোক বেরিয়ে গেলে সারিয়ে নেওয়ার। আসলে সব আগে থেকে ঠিক করা থাকে।’’ কে এমন নির্দেশ দিয়েছেন, কার সঙ্গেই বা ঠিক করা থাকে? উত্তর মেলে না। একই অবস্থা নারকেলডাঙার কষাই বস্তি ফার্স্ট লেনের একটি বহুতলেও। ৫সি নম্বরের ওই বহুতলটিও একই ভাবে ভেঙে দিয়ে গিয়েছিলেন পুরসভার কর্মীরা। সেখানেও একই ভাবে তাপ্পি মেরে ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
চাঞ্চল্যকর অভিযোগ মিলেছে ওয়াটগঞ্জ থানার কবিতীর্থ সরণি এলাকার পাথরগলি থেকেও। গত বছরের এপ্রিলে এই গলিতে একটি বেআইনি ভাবে নির্মীয়মাণ বাড়ির ছাদ থেকে লোহার রড পড়ে মৃত্যু হয় জাকির আলি নামে বছর একুশের এক তরুণের। ঘিঞ্জি জায়গার মধ্যে ওই বাড়ির নির্মাণকাজের জন্য লোহার রড দড়িতে বেঁধে তোলা হচ্ছিল। সেই সময়ে দড়ি ছিঁড়ে গেলে তা নীচ দিয়ে যাওয়া জাকিরের মাথায় এসে পড়ে। এর পরে ওই বেআইনি নির্মাণ ভেঙে দিয়ে যায় পুরসভা। কিন্তু সেখানেও গিয়ে দেখা গেল, তাপ্পি মেরে বেশ কিছু ভাঙা অংশ ঢালাই করে নেওয়া হয়েছে। সেখানকার এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘পুরসভার পুরো বেআইনি অংশটাই ভেঙে দেওয়ার কথা। তার বদলে স্থানীয় ভাবে সেটিং করে নেওয়া হচ্ছে। সামান্য কিছুটা অংশ ড্রিল করে দিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যাতে সহজেই ওই অংশটুকু তাপ্পি মেরে নিতে পারেন প্রোমোটার।’’
সাধারণ বাসিন্দাদের বড় অংশের বক্তব্য, পুরসভার বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে খরচ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ প্রোমোটারের ফাঁদে পড়ে এই ধরনের বাড়ি কিনে ঠকছেন। কোনও ভাবেই কি এই পরিস্থিতির বদল সম্ভব নয়? কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বললেন, ‘‘তাপ্পি মেরে নেওয়ার এই অভিযোগ পেয়েছি। কোনও পুরপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও কড়াপদক্ষেপ করা হবে। তবে পুলিশকেই এ ব্যাপারে আরও সক্রিয় হতে হবে। সাধারণ মানুষকেও এমন বেআইনি ফ্ল্যাট না কেনার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।’’ লালবাজারের যুগ্মনগরপাল পদমর্যাদার এক পুলিশকর্তার দাবি, ‘‘থানায় থানায় কড়া নির্দেশ পাঠাচ্ছি। অবিলম্বে এ জিনিস বন্ধ করা হবে।’’