সময়ের সঙ্গে বেড়ে চলেছে কলকাতা শহরের আয়তন। কিন্তু কলকাতার নগরায়নের গতি কী প্রাকৃতিক ভারসাম্যের দিকটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে? ইট আর কংক্রিটের প্রতিযোগিতায় কি হারিয়ে যাচ্ছে না প্রাকৃতিক সম্পদ?
পরিবেশবিদেরা জানাচ্ছেন, যে কোনও উন্নত শহরের মোট এলাকার ১৫ শতাংশ এলাকা সবুজ ও মুক্ত অঞ্চল অর্থাৎ গাছপালা ও জলাশয় থাকা দরকার। কলকাতায় যা রয়েছে মাত্র ৩ শতাংশের কিছুটা বেশি। আর এই অসমতার জন্যই কিন্তু আদর্শ শহর হয়ে উঠতে পারছে না কলকাতা, এমনটাই মত পরিবেশবিদদের।
যদিও কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (বস্তি উন্নয়ন ও পরিবেশ) স্বপন সমাদ্দারের দাবি, কলকাতা পুরসভা এলাকার পুকুরগুলির অবস্থা যথেষ্ট ভাল। বাস্তব চিত্রটি অবশ্য এর ঠিক উল্টো। পুরসভারই ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘ওল্ড মিরর’ নামে একটি বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, কলকাতার ২৪৮টি পুরনো পুকুরের বেশির ভাগেরই অবস্থা খুব খারাপ। যেমন চেতলার কাছে মিস্ত্রী পুকুর। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এর অবস্থা খুবই খারাপ। স্থানীয় লোকজন এই পুকুরটিকে স্নানের জন্য ব্যবহার করেন। কিন্তু দিন দিন জঞ্জালে ভর্তি হয়ে পুকুরটি ক্রমেই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। একই হাল বেহালার রামজীবনপুরের পুকুরগুলিরও। বেশ কয়েকটি পুকুর রয়েছে কলকাতা পুরসভার ১৪২ নম্বর ওয়ার্ডেও। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলিরও কোথাও পাঁক জমে গিয়েছে, কোথাও আবার শ্যাওলা পড়েছে। কোথাও আবার এত কচুরিপানা জন্মেছে যে পুকুরের জলই দেখা যাচ্ছে না।
তবে এ সব কথা অবশ্য মানতে নারাজ স্বপনবাবু। কলকাতা পুরসভার প্রকাশিত বইয়ের তথ্যও ভুল বলে মনে করেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতার পুকুরগুলির অবস্থা যথেষ্ট ভাল। পুরসভার প্রকাশিত কোনও বইয়ে যদি এমন কিছু বলা থাকলে তা ঠিক নয়। পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমরা গত দেড় বছর ধরে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছি। যা যথেষ্ট ইতিবাচক।’’
কলকাতা পুরসভার হিসেব বলছে, সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পুকুর রয়েছে এ শহরে। যার মধ্যে সংস্কার হয়েছে মাত্র ১২৫টির। পুরসভার এক আধিকারিকের কথায়, অর্থের অভাবেই সংস্কারের কাজ আটকে রয়েছে। কলকাতা পুরসভার প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ইউনিট এই কাজের জন্য পুরসভার কাছে ১০৬ কোটি টাকা চাইলেও, বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে মাত্র সাড়ে ছয় কোটি টাকা। এত কম টাকায় শহরের সব পুকুরের সংস্কার সম্ভব নয় বলেই জানাচ্ছেন পুরসভার পরিবেশ দফতরের কর্তারা।
মূল শহরের পাশাপাশি আশপাশের এলাকাগুলির পুকুরগুলিরও একই অবস্থা। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সভাপতি কল্যাণ রুদ্র জানান, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি হিসেবে ১২৫০০ হেক্টর জমি চিহ্নিত করেছিল রামসার কনভেনশন। যার মধ্যে ৩৫০০ হেক্টর জলাশয় হিসেবে খাতায় কলমে থাকলেও বাস্তব অন্য কথা বলছে। এখন আর এত পরিমাণ জলাশয় নেই বলে দাবি পরিবেশ দফতরের।
রাজ্য পরিবেশ দফতর জানাচ্ছে, এই জলাশয়গুলি বুজিয়ে বেআইনি ভাবে নির্মাণ গড়ে উঠছে। অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির চাপে প্রশাসনও কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছে না। যার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয়। পরিবেশবিদেরা জানাচ্ছেন, এ নিয়ে বার বার পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হলেও কখনওই পুলিশ-প্রশাসন কার্যকরী ভূমিকা নেয়নি।
কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাশয়ের অভাব কিন্তু কলকাতাবাসীর জন্যই ডেকে আনছে বড় সমস্যা, এমনটাই মত পরিবেশবিদদের। তাঁরা জানাচ্ছেন, জল ও স্থলের যে সমতা থাকা উচিত, তা না থাকলে ভূকম্পনের ভয়াবহ প্রভাবের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সামান্য কম্পনের ফল মারাত্মক হতে পারে। কলকাতার জলাশয়ের অভাব এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। তা ছাড়া, এর ফলে নষ্ট হয় বাস্তুতান্ত্রিক সমতাও। পুকুরের জলের অভাবে মিষ্টি জলের মাছও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত বলেন, ‘‘কলকাতার পুকুরের অভাব অন্য একটি সমস্যাও বাড়িয়ে তুলছে। তা হল জল জমার সমস্যা। পুকুরগুলি বৃষ্টির জল ধরে রাখত। এখন সেই সংখ্যা কমে যাওয়ায় শহরের নিকাশি ব্যবস্থাতেও তার প্রভাব পড়ছে।’’ কলকাতায় পুকুরের হাল ঠিক কেমন তা বোঝাতে তিনি বলেন, ‘‘আমি যে জায়গায় পুকুর দেখেছিলাম, আমার ছেলে সেখানে দেখল ডোবা। আর নাতি দেখল সুন্দর একটি বহুতল।’’