দূরত্ব: বিধি মেনে শহরের ওষুধের দোকানে ক্রেতারা। ছবি: রণজিৎ নন্দী
‘‘এত দিন শব্দগুলো অভিধানে ছিল। আমাদের প্রয়োজন পড়েনি, তাই ব্যবহারও করিনি। কিন্তু এখন প্রয়োজনে আমরা তার বাংলা প্রতিশব্দও ব্যবহার করছি। যেমন নিভৃতবাস, দূরত্ব-বিধি, গণ্ডিবদ্ধ এলাকা (কন্টেনমেন্ট জ়োন) ইত্যাদি।’’— বলছিলেন ভাষাবিদ সুভাষ ভট্টাচার্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানাচ্ছে, গত ডিসেম্বরে চিনের উহানে সংক্রমণের খবর পাওয়া থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত কোভিড-১৯ সংক্রমণের ছ’মাস পূর্ণ হল। বিগত সেই ছ’মাস কী ভাবে দৈনন্দিন জীবনের ভাষা-কথা বদলে দিয়েছে, সে সম্পর্কেই বলছিলেন সুভাষবাবু।
অবশ্য শুধু ভাষা বা কথোপকথনই কেন, করোনা তো পাল্টে দিয়েছে আমূল জীবনটাই। যে কারণে অনেককেই বলতে শোনা যাচ্ছে— ‘করোনা আসার আগের জীবন কেমন ছিল, সেটা তো প্রায় ভুলেই গিয়েছি!’ আক্ষেপ করে বলা হলেও তা যে ভীষণ ভাবে সত্যি, সে কথা স্বীকার করছেন বিশেষজ্ঞেরা। ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’-এর এপিডিমিয়োলজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান শম্পা মিত্রের কথায়, ‘‘আগের জীবন মনে থাকবে কী করে? করোনা এসে তো আমাদের স্বাভাবিক জীবন ওলটপালট করে দিয়েছে!’’
হু-র হিসেব বলছে, মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত বিশ্বে করোনা আক্রান্তের মোট সংখ্যা ১ কোটি ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ৩৭৪ জন, মৃতের সংখ্যা ৫ লক্ষ ৩ হাজার ৮৬২ জন। ভারতে এ দিন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত অ্যাক্টিভ রোগীর সংখ্যা ২ লক্ষ ১৫ হাজার ১২৫ জন, মৃত ১৬ হাজার ৯৮৩ জন। এমনিতে মহামারির ইতিহাস বলছে, বিশ্বের যে সমস্ত দেশ বা এলাকায় সংক্রমণজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি, সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা, বাহ্যিক আচার-আচরণে তার একটা প্রভাব পড়েই থাকে। এক বিহেভিয়োরাল সায়েন্টিস্টের কথায়, ‘‘সংক্রমণজনিত রোগের সংখ্যা যেখানে বেশি, সেই সমস্ত এলাকার নাগরিকেরা সচেতন ভাবেই সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার পন্থা আয়ত্ত করেন। পরে তা অভ্যাসে পরিণত হয়।’’
যেমন খাস কলকাতাতেই অতীতে একাধিক বার প্লেগ, কলেরা মহামারির মতো ছড়িয়েছিল বলে জানাচ্ছেন কলকাতা-গবেষক হরিপদ ভৌমিক। জানাচ্ছেন, ১৮৯৬ সালের অক্টোবরে কলকাতায় প্লেগ শুরু হয়। তার পরে ফের প্লেগের প্রকোপ দেখা দেয় ১৮৯৮ সালের এপ্রিলে। সে সময়ে শহরে সাফাইকর্মীদের অভাব বেড়ে গিয়েছিল। প্লেগের আতঙ্কে ১৮৯৮ সালের ১৫ মে কলকাতা প্রায় জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল। হরিপদবাবু বলছেন, ‘‘এখন স্বাস্থ্যক্ষেত্র, জরুরি পরিষেবায় স্বাস্থ্য-সুরক্ষার দাবি উঠছে, তা নিয়ে বিক্ষোভও হচ্ছে কখনও-কখনও। সে রকমই ১৮৯৮ সালের ২০ মে প্লেগের আতঙ্কে পুরসভার সাফাইকর্মীরা ধর্মঘট করেছিলেন! তখনও জনমানসে এমনই প্রবল ভয়ের সৃষ্টি হয়েছিল।’’
আসলে হরিপদবাবু যা বলছিলেন, তার নির্যাস হল— শুধু সময় পাল্টায়, কিন্তু মহামারির সামনে মানুষের অসহায়তা বরাবর সেই এক-ই থাকে! তবে শুধু আতঙ্ক নয়, করোনা-আবহে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও। অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার বলছেন, ‘‘ভবিষ্যতে কী আছে, কেউই জানি না। যে কোনও সময়ে চাকরি চলে যেতে পারে। তাই পণ্য ক্রয়ের পরিবর্তে মানুষের মধ্যে টাকা জমানোর প্রবণতা বাড়বে। অন্য দিকে, এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের ঝুঁকিও সহসা কেউ নিতে চাইবেন না। সব মিলিয়ে এই সঙ্কট অনেক দিন ধরে চলার আশঙ্কা রয়েছে।’’
এই আশঙ্কা পাল্টে দিচ্ছে সম্পর্কের সমীকরণও। এমনকি, তার প্রভাব পড়ছে সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্কেও। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের কথায়, ‘‘অনেক অভিভাবকেরই কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। যার ফলে জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তনও হয়েছে। হিসেব করে খরচ করতে হচ্ছে, যা সন্তানেরা অনেক ক্ষেত্রেই মানিয়ে নিতে পারছে না।’’ মনোবিদ নীলাঞ্জনা স্যান্যাল আবার বলছেন, ‘‘করোনা জীবনের স্বাভাবিক ছন্দই পাল্টে দিয়েছে। চেষ্টা করেও আমরা করোনা-পূর্বের জীবনে ফিরতে পারব না। পরিবর্তিত এই নতুন জীবন নিয়েই চলতে হবে।’’
আরও পড়ুন: পুকুরে প্রৌঢ়ের হাত-পা বাঁধা দেহ, চাঞ্চল্য
বছরের প্রথমার্ধ কেটেছে করোনা-আতঙ্কে। দ্বিতীয়ার্ধে কী রয়েছে, জানা নেই কারওরই। ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস’-এর বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান তথা ইমিউনোলজিস্ট ইন্দিরা নাথ বলছেন, ‘‘আমরা এমন একটা আতঙ্ক-অনিশ্চয়তার সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েছি, জানি না এর শেষ কোথায়। ভূমিকম্প বা অন্য যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে জানা থাকে যে, এটা একটা সময়ে শেষ হবে। কিন্তু করোনার শেষ কোথায়, এখনও অজানা!’’