কলেজ স্ট্রিটের প্রসিদ্ধ শীতলা মন্দিরের দরজা বন্ধ। দেবী যেন কোয়রান্টিনে! —নিজস্ব চিত্র।
আনলকডাউন পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। দোকানপাট থেকে শুরু করে অফিস-কাছারি সব কিছুরই দরজা খুলছে। কিন্তু সে খবর বোধহয় পৌঁছয়নি মা শীতলার কাছে। সরকার অনুমতি দিয়েছে সমস্ত মন্দির, মসজিদ, গির্জার মতো উপাসনাস্থলের দরজা ফের খুলে দিতে। কিন্তু তার পরেও দেখা গেল, কলেজ স্ট্রিটের প্রসিদ্ধ শীতলা মন্দিরের দরজা বন্ধ। দেবী যেন কোয়রান্টিনে!
তবে কি আনলকডাউনের সময়েও আপাতত তালাবন্দি হয়েই থাকতে চান মহামারির রক্ষাকর্ত্রী দেবী নিজেই? শতাব্দীর পর শতাব্দী বসন্ত, কলেরা, প্লেগের মতো মহামারি থেকে শহরবাসীকে যে দেবী রক্ষা করেছেন বলে মানুষের বিশ্বাস, সেই দেবী করোনার প্রকোপে নিজেই ঘরবন্দি! লকডাউন পর্বের শুরুর দিক থেকেই তিনি ছিলেন ভক্ত, দর্শনার্থীদের কাছে অধরা। এখনও তাই। শুধু কলেজ স্ট্রিট নয়। শহর কলকাতার অনেক প্রান্তেই দেখা গেল তালা বন্ধ কোলাপসিবল বা শাটারের পিছনে রয়েছেন দেবী।
যদিও মন্দিরের সেবাইতরা কথাটা পুরোপুরি মানতে চান না। সেবাইত পরিবারের সদস্য পাপিয়া মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মন্দির সকালে খোলা হচ্ছে। নিত্য পুজো হচ্ছে। ভক্তরাও যে আসছেন না, এমনটা নয়।” ভক্তদের জন্য মন্দিরের সামনে থাকা ফুল, ধূপকাঠির বন্ধ ডালা কিন্তু পাপিয়ার এই কথাকে মান্যতা দিচ্ছে না। মন্দিরের উল্টো দিকেই ফল বিক্রি করছিলেন শেখ রাজা। তিনি কিন্তু বলছেন, ‘‘সকালে এক বার মন্দির খোলে। কিন্তু লোকজন আসে না। আগে যেমন ভিড় হত মন্দিরে, লকডাউন উঠে যাওয়ার পরেও এখনও তেমন লোকজন আসছে না। তাই ডালা বন্ধই থাকে।”
কলেজ স্ট্রিটের শীতলা মন্দিরের দেবীমূর্তি। লকডাউনের আগে তোলা ছবি। —নিজস্ব চিত্র।
কলকাতার প্রাচীন শীতলা মন্দিরগুলোর মধ্যে রয়েছে লেবুতলা পার্কের কাছে জোড়া শীতলা মন্দির। লকডাউনের শুরুতে সেখানেও দেখেছিলাম করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক। পারিবারিক মন্দির। পুজো থেকে রক্ষণাবেক্ষণ— সবটাই এখানকার পণ্ডিত পরিবার করেন। বাড়ি লাগোয়া মন্দির। আনলকডাউন শুরু হওয়ার পর ওই পরিবারের রবিন পণ্ডিত বললেন, ‘‘মন্দিরে আগের মতোই নিত্য পুজো হচ্ছে।” তাঁর কথায়, ‘‘মন্দির খোলার ব্যাপারে সরকার ছাড় দিলেও বিধিনিষেধ আছে। এমন কোনও উৎসব-অনুষ্ঠান করা যাবে না, যেখানে জমায়েত হতে পারে। তাই লোকজনের আসা-যাওয়া কম।’’ জোড়া শীতলা মন্দিরের অন্যটি পণ্ডিতদের মন্দিরের ঠিক উল্টো দিকে। সেখানেও বন্ধ কোলাপসিবল গেটের আড়ালেই রয়ে গিয়েছেন দেবী।
আরও পড়ুন: করোনার দৈব শিকার: স্বয়ং মা শীতলাই লকডাউনে
গোটা শহর জুড়ে বেড়েই চলেছে করোনার প্রকোপ। লকডাউনের শুরুর দিকে কলেজ স্ট্রিট হোক বা লেবুতলা, করোনা আক্রান্ত কেউ ছিলেন না। আনলকডাউন পর্যায়ে ছবিটা বদলে গিয়েছে অনেকটাই। গোটা রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। জুন মাসের প্রথম থেকেই প্রতি দিন সরকারি হিসাবে রাজ্যে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন ৩০০-৪০০ জন করে। শহরের প্রতিটা প্রান্তেই পড়েছে করোনার থাবা। শুধু কলকাতা শহরেই আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২ হাজার ৬০০ জন।
আরও পড়ুন: ভর্তি হওয়া রোগীর করোনা, এ বার কসবায় সিল নার্সিংহোম
শহর জুড়ে যখন এমন পরিস্থিতি, তখন মহামারির দেবী কোথায়? স্কন্দ পুরাণ থেকে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সর্বত্রই মা শীতলার উল্লেখ রয়েছে মহামারির নিয়ন্তা হিসাবে। ব্রিটিশ ভারতে, এই বাংলায় বারে বারে গুটিবসন্ত থেকে শুরু করে কলেরা, মহামারির আকার ধারণ করেছে। আর সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়েই জে জেড হলওয়েল, জন মুর বা সি এইচ বাক শীতলার কথা লিখেছেন মহামারির দেবী হিসাবে। তাঁদের লেখায় উঠে এসেছে, মহামারির বিভীষিকা থেকে বাঁচতে সমাজের কতটা গভীরে মা শীতলার প্রভাব বিস্তৃত।
প্রসার ভারতীর প্রাক্তন মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক জহর সরকার একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘রোগের মোকাবিলায় ধর্মেরও একটা ভূমিকা চলে আসে। বিচিত্র লোকাচারও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র আত্মসাৎ করে শীতলাকে দেবী তৈরি করে। লোকায়ত ভাবে একটা পাথরখণ্ড বা অন্য কোনও প্রতীকের, এমনকি একটা কলসির পুজো করা হত শীতলা হিসাবে। বহু যুগ ধরে তিনি পূজিত হয়েছেন একটি কালো পাথর কিংবা বটগাছের নীচে একটি বেদীর উপর হলুদ কাপড়ে ঢাকা পাথরের টুকরো হিসাবে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট মানবপ্রতিম মূর্তি না হলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের চলে না। তাই জন্ম হল শীতলার আজকের রূপের।’’ জহর বাবু লিখেছেন, ‘‘প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুধর্ম বার বার শীতলাকে পরিশুদ্ধ করতে তৎপর হয়েছে, কিন্তু পেরে ওঠেনি, এটা তাঁর মাহাত্ম্যেরই প্রমাণ। গুটিবসন্ত বিদায় নিয়েছে, কিন্তু মা শীতলা গাধায় চড়ে নিয়মিত আসছেন এবং ঝাঁট দিচ্ছেন।”
করোনা অতিমারির সময়ে অন্য দেবদেবীর মতো নিজেও কোয়রান্টিনে মা শীতলা। ভক্তদের ভিড় থেকে তাঁর দূরে থাকা কি তবে লোকায়ত শীতলার প্রাতিষ্ঠানিক পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়া পূর্ণ হওয়ার ইঙ্গিত? না, ২০২০-র কোভিড-১৯ মহামারি কোথাও ইঙ্গিত দিচ্ছে, অতিমারির দৈব যোগাযোগের শিকড় ধীরে ধীরে আলগা হয়ে গিয়েছে জনজীবন থেকে?