ফাইল চিত্র।
হাতে সময় আর মাত্র ২৮ মাস। তার মধ্যেই প্রায় ৩৮ লক্ষ টন স্তূপীকৃত বর্জ্য (লিগ্যাসি ওয়েস্ট) প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে কি ধাপা এলাকার জল-স্থল-বাতাসের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? কোটি টাকার এই প্রশ্নই আপাতত ঘুরপাক খাচ্ছে রাজ্য প্রশাসনের অন্দরে।
কারণ রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, ধাপায় প্রায় ৬০ একর জায়গা জুড়ে স্তূপীকৃত বর্জ্যের পরিমাণ ৪০ লক্ষ টনের মতো। তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত বায়ো-রেমিডিয়েশন প্রক্রিয়ার (সজীব বস্তু ব্যবহার করে
মাটি, জল বা এলাকার দূষণ কমানোর পদ্ধতি) মাধ্যমে ১.৭৯ লক্ষ টন বর্জ্যের প্রক্রিয়াকরণ করা গিয়েছে। দফতর সূত্রের খবর, বাকি ৩৮.২১ লক্ষ টন বর্জ্যের প্রক্রিয়াকরণ করে ৬০ একর জমি পুনরুদ্ধারের সময়সীমা ধার্য করা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন। যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ আদালত ওই সময়সীমার মধ্যেই কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য তথা
কলকাতা পুরসভাকে। প্রয়োজনে ওই কাজে ব্যবহৃত কঠিন বর্জ্য পৃথকীকরণ যন্ত্রের (ট্রমেল) সংখ্যাও বাড়াতে বলেছে।
প্রশাসনের একাংশের সংশয়, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারার জন্য জরিমানার মুখে পড়তে হবে না তো রাজ্য সরকারকে? অতীতে বায়ুদূষণ রোধে ব্যর্থ হওয়ার জন্য রাজ্যকে জরিমানা করেছিল পরিবেশ আদালত। আবার, কলকাতা পুরসভার গার্ডেনরিচ ভাগাড়ে স্তূপীকৃত বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য বায়ো-রেমিডিয়েশন প্রক্রিয়া চালু না হওয়ায় মাসে ১০ লক্ষ টাকা খেসারত দিতে হয়েছে রাজ্যকে। যদিও কলকাতা পুরসভার এক কর্তার কথায়, ‘‘নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ হবে। সেই মতো পরিকল্পনাও করা হয়েছে।’’ কিন্তু তাতেও সংশয় কাটছে কই?
সংশয়ের কারণ, শুধু ধাপার ক্ষেত্রে নয়, দেশের সব ভাগাড়েই স্তূপীকৃত বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের উপরে জোর দিয়েছে পরিবেশ আদালত। এই ব্যাপারে নির্দিষ্ট সময় অন্তর আদালতে ‘কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট’ও জমা দিতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে।
ফলে বিষয়টিকে যে আর হাল্কা ভাবে দেখা যাবে না, তা মোটামুটি সবার কাছেই স্পষ্ট। এমনিতে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য জানাচ্ছে, দেশের মোট ৩১৫৯টি ভাগাড়ে ফেলা বার্ষিক বর্জ্যের পরিমাণ ২ কোটি ৩৩ লক্ষ ৫৪ হাজার ৫৪৬ টন। পশ্চিমবঙ্গে ভাগাড়
রয়েছে ৮৮টি। তাতে ফেলা বার্ষিক বর্জ্যের পরিমাণ ১,২১,৯১০ টন। সেখানে কলকাতায় রোজ তৈরি হয় ৪৫০০ টন বর্জ্য। দৈনিক বর্জ্য উৎপাদনের নিরিখে দেশের ৪৬টি মেট্রো শহরের মধ্যে কলকাতার স্থান চতুর্থ। মুম্বই, দিল্লি ও চেন্নাইয়ের পরে। ফলে দৈনিক জঞ্জাল প্রক্রিয়াকরণের পাশাপাশি স্তূপীকৃত বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের চাপও রয়েছে।
পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ (সিএসই) তাদের রিপোর্টে
যথার্থই বলেছে— বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা বর্জ্যের কারণে ভাগাড়গুলি ক্রমশ ‘টিকিং টাইম বম্ব’ হয়ে উঠেছে। কারণ জমে থাকা বর্জ্য-নিঃসৃত নোংরা এবং কালো তরল
মাটি ভূগর্ভস্থ জলে মিশে তাকে দূষিত করে তুলছে। আবার ভাগাড় থেকে নির্গত মিথেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মতো গ্যাস সংশ্লিষ্ট এলাকার বায়ুদূষণের কারণ। এক পরিবেশবিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘শুধু তা-ই নয়, কোনও ভাগাড়ে ২০-৩০ বছরের জমা জঞ্জালের চাপে ওই এলাকার জমি বসে যাওয়ার আশঙ্কা
থাকে। যা সেখানকার বিল্ট এনভায়রনমেন্ট, যেমন নির্মাণ, নিকাশি, গ্যাস পাইপের মতো পরিকাঠামোর উপরে চাপ সৃষ্টি করে।’’
সেখানে কলকাতা পুরসভার তথ্য বলছে, ধাপার ৬০ একর এলাকায় স্তূপীকৃত বর্জ্য জমা হচ্ছে সেই
১৯৮৭ সাল থেকে। এক প্রশাসনিক কর্তার বক্তব্য, ‘‘সিএসই-র রিপোর্টের কথা মতো বলতে হয়, ৩৫ বছরের টাইম বম্ব এই মুহূর্তে রয়েছে
ধাপায়।’’
যার ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা, টিকটিক করে চলতে থাকা সেই ‘দূষণ-বোমা’র বিস্ফোরণ আটকে ধাপা এলাকাকে
অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য প্রশাসনের হাতে সময় রয়েছে আর মাত্র ২৮ মাস!