বার্তা: প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনাসভায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
প্রকাশ্যে বলা যায় না এ কথা। বললে সমাজ ভুরু কোঁচকায়। কেন? সেই প্রশ্ন তুলতেই সম্প্রতি আলোচনা বসেছিল প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আনন্দবাজার পত্রিকার ‘শহর কী বলছে’-র এই পর্বের বিষয় ছিল— ‘পিরিয়ড নিয়ে এখনও ছুতমার্গ? কী বলছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়?’ পড়ুয়াদের পাশাপাশি আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন শীঘ্রই মুক্তি পেতে চলা বাংলা ছবি ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’-র নায়িকা ঋতাভরী চক্রবর্তী, ছবিটির সংলাপ রচয়িতা তথা কবি সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার ‘প্যাডম্যান’ শোভন মুখোপাধ্যায় এবং প্রেসিডেন্সির পড়ুয়া সুজাত দত্ত ও মঞ্জিমা দাশগুপ্ত।
ছুতমার্গ রয়েছে কি না তা নিয়ে আলোচনায় যখন বসতে হয়, তখনই হয়তো স্পষ্ট হয়ে যায় ঋতুচক্র নিয়ে কথা বলতে আমাদের জিভের আড় ভাঙেনি। এটা স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া— প্রকাশ্যে এই কথা বারবার বলে কি এই জড়তা কাটানো সম্ভব? আলোচনায় উঠে এল সেই বার্তাই। অভিনেত্রী ঋতাভরী বললেন, ‘‘বাড়িতে পিরিয়ড নিয়ে বাবা-কাকা-দাদা-ভাইদের সঙ্গে আলোচনা করা যায় না। চিরকাল এটা চেপে রাখার শিক্ষাই দেওয়া হয়। কেন? এটা কি অপরাধ? সহজ ভাবে এটা নিয়ে কথা বলা দরকার।’’
সম্রাজ্ঞী জানালেন আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের ভাষার মধ্যেই এই ট্যাবু রয়ে গিয়েছে। ‘শরীর খারাপ’ বলে আমরা বরাবর পিরিয়ডকে আড়াল করে রেখেছি।’’ তা ছাড়া, ঋতুমতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃত্বে পৌঁছে যাওয়ার সাফল্যকে এক করে দেখার যে প্রবণতা রয়েছে সমাজে, তাকেও প্রশ্ন করতে চান সম্রাজ্ঞী— ‘‘মা হওয়া বা না হওয়া কারও পছন্দের বিষয়। তার জন্য ঋতুমতী হয়ে মা না-হলে কেউ অশুচি, এ ভাবনা কেন কাজ করে?’’
গ্রামেগঞ্জে ঋতুকালীন সচেতনতা বাড়াতে কাজ করেন বছর তেইশের শোভন। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ওই তরুণ বলছেন, ‘‘প্রত্যন্ত গ্রামে মহিলাদের হাতে প্যাড দিতে গেলে বাড়ির পুরুষদের হুমকি শুনতে হয়। ওষুধের দোকানে স্যানিটারি ন্যাপকিন মোড়া থাকে কালো প্যাকেটে!’’ এত বাধার মুখে পড়েও শোভন অবশ্য নিজের কাজটা করে চলেছেন।
পড়ুয়া সুজাতের স্বীকারোক্তি, ‘‘পুরুষ হিসেবে লিঙ্গ-ইতিহাসে আমার জাতির ভূমিকায় আমি লজ্জিত। এটা সবাই স্বীকার করলে ভাল। প্রেসিডেন্সির মতো প্রতিষ্ঠানেও ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন নিয়ে কথা বলতে গেলে হোঁচট খেতে হয়।’’ মঞ্জিমা মনে করালেন, সিনেমার মতো মাধ্যমেও কী ভাবে ঋতুকালীন সময় নিয়ে হেয় মন্তব্য করে বিষয়টার স্বাভাবিকতা এবং গুরুত্ব লঘু করা হয়। তাঁর কথায়, ‘‘মাসিক চলছে নাকি! মেয়েদের মতো কথা বলছিস কেন— এ ধরনের সংলাপই তার প্রমাণ।’’
আলোচনায় উপস্থিত ছিল স্কুলপড়ুয়া সৃজা পাঠক এবং স্বরিকা সোনথালিয়া। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে ওই দুই পড়ুয়া। এই দুই বন্ধু জানাচ্ছে, কলকাতার আধুনিক কো-এড স্কুলে এখনও প্যাড পাল্টাতে যাওয়ার সময়ে সেটা ঢেকে নিয়ে যাওয়াটাই দস্তুর।
শ্রোতাদের মধ্যে ছাত্রী অংশুমিতা সরকার বললেন, ‘‘মায়ের সঙ্গে এটা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলে ভ্রান্ত ধারণা ভাঙার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাবার বেলায়? সেই আটকে যেতে হয়।’’ আর এক ছাত্র অর্ণব চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘মা খুব সচেতন অনেক বিষয়েই। কিন্তু এ ব্যাপারে আটকে গিয়েছিলেন। কিছু অসুবিধের কারণে শেষ পর্যন্ত মাকে আমিই ন্যাপকিন কিনে এনে দিয়েছি।’’ আলোচনায় উঠে এল আরও তথ্য— মেনোপজে পৌঁছে যাওয়া অনেক মহিলা জানেনই না, এত দিন পর্যন্ত তাঁর শরীরে ঠিক কী কী ঘটেছে! এই জন্যেই সচেতনতা গড়ে তুলতে সহজ আলোচনা ছোট বয়স থেকে হওয়া দরকার। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে ঋতু-সংস্কার ভুলুক সবাই, ইচ্ছে রইল সকলেরই।