গাড়ির মাথায় বাতি, ভিড়ে সমস্যা ভি আই পি-রা

পদাধিকার বলে যাঁরা গাড়ির মাথায় লাল বা নীল বাতি লাগানোর সুযোগ পান, তাঁরা অনেকেই ব্যক্তিগত যাতায়াতের ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করেন।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৬ ০২:০১
Share:

পদাধিকার বলে যাঁরা গাড়ির মাথায় লাল বা নীল বাতি লাগানোর সুযোগ পান, তাঁরা অনেকেই ব্যক্তিগত যাতায়াতের ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করেন। ফলে নিয়ম মাফিক ট্র্যাফিক সিগন্যালে অগ্রাধিকারও পান তাঁরাই। এটাই চেনা ছবি। এমনকী, ওই পদাধিকারীরা নিজেরা গাড়িতে না থাকলেও তাঁদের আত্মীয়স্বজন সেই সময়ে গাড়ি চড়ে সুবিধে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ। লালবাজারের মতে, পুজোর ভিড়ে বাড়তি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এই গাড়িগুলি। কারণ ইতিমধ্যেই যানজটে নাস্তানাবুদ শহর।

Advertisement

ট্রাফিক পুলিশ সূত্রের খবর, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালের আলো লাল থাকা অবস্থায় ১৫-২০টি সাধারণ গাড়ির পিছনে থাকা বাতি লাগানো গাড়িকে রাস্তা দিতে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই সিগন্যাল সবুজ করে দিতে হয়। যার প্রভাব পড়ে পরের বা সামনের মোড়ে। ফলে গাড়ির চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। আবার অনেক সময়ে লাল সিগন্যালে একেবারে সামনের দিকে দাঁড়ানো বাতিওয়ালা গাড়িকে সিগন্যালে কোনও বদল ছাড়াই বার করে দেয় পুলিশ। পুজোর ভিড়ে তা করতে গেলে সমস্যা বাড়ার আশঙ্কা করছে পুলিশ।

পঞ্চমীর পরে পুজোর ক’টা দিন আর বাড়ি থেকে বেরোন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘আমি বাড়িতে বসে সব দিকে নজর রাখি। আমাদের মতো যাঁদের ক্ষেত্রে বেরোতে হলে সঙ্গে পুলিশ যায়, পুলিশি ব্যবস্থা রাখতে হয়, গাড়িতে লাল আলো থাকে, তাঁদের জন্য সাধারণ মানুষের যাতায়াতে অসুবিধে হয়। আমি সেটা চাই না। অনেকে অবশ্য উৎসবের ভিড়েও লাল বাতি জ্বালানো গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরোন। আমার সেটা ভাল লাগে না।’’

Advertisement

লালবাজারের এক কর্তার বক্তব্য, মাথায় লাল বা নীল আলো লাগানো গাড়ি চড়ার অধিকার রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী, বিচারপতি থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক সংসদের চেয়ারম্যান পর্যন্ত বিভিন্ন পদমর্যাদার মানুষকে দেওয়া হয়েছে। গুরুত্ব অনুযায়ী, কারও ফ্ল্যাশার-সহ লাল আলো, কারও বা ফ্ল্যাশার ছাড়া। নীল আলোর ক্ষেত্রেও ফ্ল্যাশার থাকা, না-থাকার প্রভেদ আছে। এক পুলিশকর্তার মতে, গাড়ির মাথায় ওই আলো রাখার মূল কারণ, জরুরি প্রয়োজনে যাতে এক জায়গা থেকে অন্যত্র যেতে দেরি না হয়। অথচ ওই অফিসারের কথায়, ‘‘ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণেও অনেকে গাড়িতে আলো লাগিয়ে দাপিয়ে যাচ্ছেন। যখন-তখন, যত্রতত্র বাতি লাগানো গাড়ি ব্যবহার হচ্ছে। গাড়িতে আলো থাকা মানেই যেন ক্ষমতা!’’

কিছু দিন আগে আকাশবাণী ভবনের কাছে সেই ক্ষমতার রোষানলে পড়েন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আয়ুষী সিংহ। একটি বাইককে বাঁচাতে গিয়ে তাঁর গাড়ি টোকা দিয়ে ফেলে এক নীল বাতির গাড়িকে। সেই গাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের এক কর্তার। তখন তিনি গাড়িতে ছিলেন না। অথচ তাঁর গাড়িচালক নেমে এসে আয়ুষীর গাড়ির সমস্ত নথি ছিনিয়ে নিয়ে যান। বাইপাসে সম্প্রতি ‘রাস্তা না ছাড়ায়’ বাতি লাগানো গাড়ির চালক ও আরোহীর কটূক্তি ও হুমকির মুখে পড়েন এক কর্পোরেট কর্তা। গাড়িতে লেখা ছিল, সেটি এক বিচারপতির। তখন সন্ধ্যা। এমন নয় যে, বিচারপতি তখন আদালতে যাচ্ছিলেন।

বম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ‘‘আদালতে যাওয়ার সময়ে বিচারপতিদের তাড়া থাকে। সেটা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু অন্য সময়ে?’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘ক্ষমতা থাকলেই তার অপব্যবহার করতে হবে, তার মানে নেই। অন্যদের তো বটেই, বিচারপতিদেরও গাড়িতে লাল আলোর ব্যবহার সীমিত করা প্রয়োজন। বিশেষত রাস্তাঘাটে পুজোর ভিড়ে তো একেবারেই নয়।’’ সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘আদালতের নির্দেশ, সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে পরিষ্কার বলা আছে, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে এই অধিকার বা ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাবে না। সেটা বিচারপতিদেরও মেনে চলা উচিত। পশ্চিমের অনেক দেশে কিন্তু সরকারি প্রয়োজনেও সব সময়ে নয়, শুধু জরুরি ক্ষেত্রেই বাতি লাগানো গাড়ি ব্যবহার করা হয়।’’

কলকাতা হাইকোর্টের এক প্রাক্তন বিচারপতি বলেন, ‘‘এক বার ওয়াশিংটন ফরেন প্রেস সেন্টারে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা হোয়াইট হাউসের পদস্থ কর্তা রাশাদ হোসেনের। বাইরে প্রবল বৃষ্টি, যানজট। প্রেসিডেন্ট ওবামার বিশেষ দূত রাশাদ কিন্তু গা়ড়ি বহু দূরে রেখে ছাতা মাথায় হেঁটেই প্রেস সেন্টারে ঢোকেন। সেই জায়গায় এখানকার অবস্থাটা ভাবুন।’’ রাজ্য পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘ও সব দেশের সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গিই আলাদা। এখানে বহু মানুষ অনেক সময়েই অকারণে গাড়িতে বাতি লাগানোর সুবিধা নেন। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।’’

বামফ্রন্ট জমানায় সুভাষ চক্রবর্তী পরিবহণমন্ত্রী থাকাকালীন মন্ত্রিসভার সদস্যদের অনেকের গাড়িতেই লাল আলো বন্ধ করা হবে বলে প্রস্তাব দেন। তা শেষে কার্যকর হয়নি। এখন প্রতিমন্ত্রীরাও লাল আলো লাগানো গাড়ি চড়েন, আর পূর্ণমন্ত্রীরা ফ্ল্যাশার-সহ লাল আলো, অর্থাৎ দপদপ করে জ্বলা লাল আলো বসানো গাড়ি পান।

কিছু দিন আগের কথা। টালিগঞ্জে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রোড ধরে লাল আলো লাগানো এসইউভি ছুটিয়ে যাচ্ছিলেন রাজ্যের এক মন্ত্রী। ছুটির দুপুর। সামনে থাকা একটি মোটর বাইকে দুই পুলিশকর্মী তখন হাঁক দিচ্ছেন, অন্য সব যানবাহন যাতে রাস্তার দু’পাশে সরে যায়। লাল আলোর দাপট বলে কথা!

ব্যতিক্রম অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী। গাড়ির সামনে পাইলট কার নেওয়া দূরে থাক, নিয়ম মেনে প্রতিটি সিগন্যালে আর পাঁচটা গাড়ির মতো দাঁড়ানোই অভ্যাস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement