ছবি: সংগৃহীত
তাঁদের কারও হৃদ্যন্ত্রের একটি ভাল্ভ অকেজো, কারও বা দু’টিই। সঙ্গে প্রবল শ্বাসকষ্ট। কর্মক্ষমতা হারিয়ে তাঁরা পুরোপুরি শয্যাশায়ী। বেশির ভাগেরই বয়স ২০-৫০ এর মধ্যে। অবিলম্বে ভাল্ভ না-বসালে যে কোনও সময়ে হৃদ্যন্ত্র থেমে যেতে পারে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁরা ছুটে এসেছেন কলকাতার অন্যতম সেরা সরকারি হাসপাতাল বলে পরিচিত আর জি করে।
কিন্তু অভিযোগ, সেখানে দ্রুত সেরে ওঠার পরিবর্তে তাঁরা জটিলতর সঙ্কটের সম্মুখীন। কারণ, দুর্গাপুজোর পর থেকে ভাল্ভ বসানোর কাজ কার্যত বন্ধ আর জি করে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অবস্থা ঘোরালো হতে শুরু করেছিল পুজোর আগে থেকেই। পুজোর পরে গোটা প্রক্রিয়া জট পাকিয়ে গিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন, অর্থের সঙ্কট থাকায় ভাল্ভ কেনা যাবে না। ফলে বিকল ভাল্ভ নিয়েই কেউ দেড় মাস, কেউ তিন মাস ভর্তি হয়ে রয়েছেন। যাঁরা আর্থিক ভাবে কিছুটা হলেও সচ্ছল, তাঁরা কড়া নাড়ছেন অন্য সরকারি হাসপাতাল বা বেসরকারি হাসপাতালের দরজায়।
কার্ডিয়োভাস্কুলার বিভাগের চিকিৎসকদের অনেকেই জানাচ্ছেন, যখন ভাল্ভের ঘাটতি ছিল না তখন মাসে গড়ে ১০-১২ জন করে রোগীর হৃদ্যন্ত্রের ভাল্ভ প্রতিস্থাপন করা হত। এখনও রবিবার বাদে প্রতিদিন বহির্বিভাগে গড়ে ৮০-১০০ জন রোগী আসেন। তাঁদের ৫-১০ শতাংশেরই ভাল্ভ এতই খারাপ যে, অবিলম্বে অস্ত্রোপচার দরকার। কিন্তু এই সঙ্কটে ওই রোগীদের হয় প্রত্যাখ্যান করতে হচ্ছে, অথবা এসএসকেএমে পাঠাতে হচ্ছে।.
আরও পড়ুন: অস্ত্রোপচারের পরপরই হৃদ্রোগ, কোমায় তরুণী
আর জি করের এক প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, ‘‘এসএসকেএমে আমাদের বন্ধু-ডাক্তারেরা ভাবছেন, আমরা কাজ এড়াচ্ছি। কিন্তু ভাল্ভ না থাকলে আমরা কী করতে পারি? যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ভর্তি, তাঁদের পরিজনেরা আমাদের দোষারোপ করছেন। কত দিন ওই রোগীদের ওষুধ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখব?’’
হাসপাতাল সূত্রের খবর, কার্ডিয়োভাস্কুলার বিভাগে শয্যা ৬৪টি। সেখানে করোনারি বাইপাস, হার্টে ফুটো, ফুসফুসের অসুবিধাজনিত রোগীদের সঙ্গেই থাকেন ভাল্ভ খারাপ হওয়া রোগীরা। পুজোর আগে ১৫ জন রোগী জরুরি ভিত্তিতে ভাল্ভ প্রতিস্থাপনের জন্য এখানে ভর্তি হন। তাঁদের মধ্যে সাত জন ইতিমধ্যে অপেক্ষা করে করে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। বাকি আছেন আট জন। তাঁদের কেউ এসেছেন আলিপুরদুয়ার থেকে, কেউ সুন্দরবন, কেউ বালুরঘাটের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। বেসরকারি জায়গায় ৬৫-৭০ হাজার টাকা দিয়ে এক-একটি ভাল্ভ প্রতিস্থাপনের কথা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেন না। তাঁদেরই এক জন বললেন, ‘‘আড়াই মাস ধরে পড়ে আছি। ডাক্তারবাবুরা চলে যেতে বলেছিলেন। আমি বলি, বাইরে চিকিৎসা করানোর ক্ষমতা নেই। মরলে এখানেই মরব।’’
কেন এমন অর্থসঙ্কট?
আর জি করের সুপার মানস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘টাকার কথা স্বাস্থ্য ভবনে জানিয়েছি। আর কোন কোন রোগীর ভাল্ভ এখনই পাল্টাতে হবে, সেটা ডাক্তারবাবুরা জানালে ব্যবস্থা নেব।’’ কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার করতে হবে মনে করেই তো রোগীদের ভর্তি করা হয়েছে। তা হলে আবার হাসপাতাল কর্তাদের জানিয়ে ভাল্ভ নিতে হবে কেন? কেনই বা সঙ্কটজনক রোগীদের দু’মাস-তিন মাস ফেলে রাখা হবে? সুপার বলেন, ‘‘এটা ডাক্তারেরা বলতে পারবেন।’’ যা শুনে কার্ডিয়োভাস্কুলার বিভাগের এক প্রবীণ চিকিৎসক বলছেন, ‘‘এর পরে আমার কিছু বলার নেই।’’ আর স্বাস্থ্য ভবনের ড্রাগ ও ইকুইপমেন্ট বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি অরূপ দত্ত দাবি করেছেন, ‘‘টাকার অভাবে ভাল্ভ কেনা হচ্ছে না, এমন কোনও তথ্য আর জি কর আমাদের জানায়নি।’’
প্রসঙ্গত, রাজ্যে মূলত এসএসকেএম এবং আর জি করে হার্ট ভাল্ভ প্রতিস্থাপন হয়। সেখানে আর জি করে এমন পরিস্থিতিতে সমস্ত চাপ গিয়ে পড়েছে এসএসকেএমের উপরে। সেখানে অবশ্য ভাল্ভের সরবরাহে ঘাটতি নেই। কিন্তু বছরের শেষে অধিকাংশ চিকিৎসক ছুটিতে। ফলে আপাতত ২ জানুয়ারি পর্যন্ত সেখানে অস্ত্রোপচার বন্ধ। এই মুহূর্তে সেখানে ভর্তি হয়ে দেড়-দু’মাস অপেক্ষায় রয়েছেন ২০ জন। কবে ডাক আসবে, সেই অপেক্ষাতেই দিন গুনছেন তাঁরা।