পুনর্ব্যবহার: (১) পুরনো টায়ার ছাঁচে ফেলে খাঁজ কেটে তৈরি হয়েছে রিসোল টায়ার।ছবি: সুমন বল্লভ
বছর আসে, বছর যায়। বদলায় না রিসোল করা টায়ারের ব্যবসা। ফেলে আসা বছরে যে ক’টি বড় পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার বেশির ভাগের সঙ্গেই রিসোল টায়ারের যোগ পাওয়া গিয়েছে। অথচ সব জেনেও কার্যত চুপ পুলিশ। বছর শেষে পরিসংখ্যান দিয়ে তারা জানাচ্ছে, ধরপাকড় চলছে। ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তবু এই প্রবণতা কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না? উত্তর নেই। টায়ার ব্যবসার উপরে নজরদারি নিয়ে ওঠা নানা প্রশ্নেরও কোনও উত্তর মেলেনি। ফলে শহরেই রমরমিয়ে চলছে রিসোল টায়ারের প্যাকেজ ব্যবসা!
কেমন এই প্যাকেজ? একটি গাড়ির চারটি নতুন টায়ার দিয়ে দিলেই রিসোল টায়ার তো মালিক পাবেনই, সঙ্গে গাড়ির কভার এবং আরও দু’-একটি জিনিসও হয়ে যাবে। জানালেন রিসোল টায়ারের এক কারবারি। তাঁর কথায়, “গত মাসেই এই প্যাকেজে দশটা নতুন গাড়ির সব টায়ার রিসোল লাগিয়ে দিয়েছি।”
কী ভাবে হয় এই কাজ? এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে টায়ার কুড়ানিদের। তাঁদের কুড়িয়ে আনা টায়ার কেটে ছাঁচে ফেলে তৈরি হয় নতুন টায়ারের উপরের অংশের মতো নকল ‘গ্রিপ’। সেই গ্রিপ বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে পুরনো টায়ারের উপরে বসিয়ে দেওয়া হয়। এর পর বিশেষ যন্ত্রে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টায়ারটিকে গরম করলেই তৈরি হয় নতুনের মতো দেখতে রিসোল টায়ার।
আরও পড়ুন: কমছে সংক্রমণ, রাজ্যে এক হাজারের নীচে নেমে এল দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা
আরও পড়ুন: সোমে কলকাতায় বাইক র্যালিতে শোভন-বৈশাখী, সঙ্গে কৈলাসও
মল্লিকবাজারের এমনই একটি টায়ারের গুদামের এক কর্মী শেখ ফিরোজ জানালেন, বেশ কিছু দিন চলার পরে নতুন টায়ারের নীচের অংশ ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। একটা সময়ের পরে সেই টায়ার মাটি কামড়ে চলতে পারে না। পিছলে যায়। এই সময়েই নতুন টায়ার লাগানো উচিত। কিন্তু কম খরচে কাজ সারতেই গাড়ির মালিকেরা রিসোল টায়ারে আগ্রহী হন।
ফিরোজ বলেন, “নতুন টায়ার কিনতে যেখানে ৮-১০ হাজার টাকা লাগে, সেখানে ১৫০০ টাকা দিলেই রিসোল টায়ার হয়ে যায়। শহরে অনেক গোপন বাজার আছে, যেখানে ৭০০-৮০০ টাকাতেও ওই কাজ হয়।” আবার বহু গাড়ির মালিক নতুন কেনা গাড়ির টায়ার বিক্রি করে প্যাকেজে রাজি হয়ে রিসোল টায়ার কিনে নেন বলেও জানাচ্ছেন এন্টালির এক ব্যবসায়ী।
২০১৮ সালের মার্চ-এপ্রিলে লাগাতার পথ দুর্ঘটনার জেরে রিসোল টায়ারের বিষয়টি নতুন করে শোরগোল ফেলে। কয়েকটি বাস দুর্ঘটনায় রেষারেষির সময়ে ব্রেক না ধরার কথা জানায় কলকাতা পুলিশের ফরেন্সিক বিভাগ। দেখা যায়, বাসগুলির ৯০ শতাংশই ব্যবহার করছিল ওই টায়ার। তাতে ব্রেক তো ধরেই না, উপরন্তু গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যাওয়ারও ঝুঁকি প্রবল। এই টায়ারে পিছলেও যায় গাড়ি। এর পরেই পুলিশ নতুন করে ধরপাকড় শুরু করে।
পুলিশেরই হিসেব, রিসোল টায়ার ব্যবহারের জন্য ২০১৮ সালে প্রায় ২২ হাজার গাড়িকে কেস দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ন’হাজার বাস এবং আট হাজার ট্যাক্সি ছিল। ২০১৯ সালে এর ব্যবহার কিছু কমে মোট কেস হয় ১৭ হাজার। তার মধ্যে বাসের সংখ্যা সে বার হয় ১০ হাজার এবং ট্যাক্সি চার হাজার। ২০২০ সালের দুর্ঘটনার চূড়ান্ত রিপোর্ট এখনও তৈরি না হলেও লালবাজারের ট্র্যাফিক বিভাগের সূত্র জানাচ্ছে, গত বছর দীর্ঘ সময়ে লকডাউন চললেও রিসোল টায়ারের কেস হয়েছে প্রায় ১০ হাজার! শুধু তাই নয়, এ বার বাসকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে ট্যাক্সি ও অটো। বেশ কিছু ব্যক্তিগত গাড়িতেও এই টায়ার ব্যবহারের জন্য মামলা হয়েছে।
শ্যামবাজার পাঁচমাথা মোড়ের কাছের একটি টায়ারের দোকানের মালিকের দাবি, “এই টায়ার আমাদের ব্যবসা তো মারছেই, মানুষও মারছে। বাস-ট্যাক্সি খরচ বাঁচাতে এই টায়ার লাগাচ্ছে। লকডাউনের পরে ট্যাক্সি-অটোর চালকেরাও এই পথেই হাঁটছেন।”
কলকাতা পুলিশ জানাচ্ছে, এই ধরনের টায়ার তৈরি বেআইনি নয়। তবে ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে। ব্যবহারের তিন মাস বা ছ’মাস পার হলেই মামলা করা হয়। এখানে কি ফাঁক থেকে যাচ্ছে? কারণ, বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, এই টায়ার লাগানোর দিন কয়েকের মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি এ জে সি বসু রোড উড়ালপুলে যাত্রী নিয়ে উল্টে যাওয়া মালবাহী গাড়িতেও এই টায়ার ছিল বলেই অভিযোগ।
এ বিষয়ে ডিসি (ট্র্যাফিক) রূপেশ কুমারের বক্তব্য, “সব গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেখা সম্ভব হয় না। কড়া নজরদারি চালানো হচ্ছে। লাগাতার ধরপাকড়ও চলছে।”