১৮৫ বছরে
“ভাষায় প্রাণ সকলের চাইতে বড়ো, জাতির প্রাণ অপেক্ষা ভাষার প্রাণ বেশি বড়ো... সেই প্রাণদানকারীকে আজ আমাদের সকলের নমস্কার।” বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মস্থানে আয়োজিত এক সভায় বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যসম্রাটের ১৮৫তম জন্মবার্ষিকী চলে গেল গত ২৯ জুন। নৈহাটি কাঁটালপাড়ায় তাঁর জন্মভিটে তথা বসতবাড়িতে রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা দফতর পোষিত বঙ্কিম-ভবন গবেষণা কেন্দ্রে হয়ে গেল চার দিন ব্যাপী বঙ্কিম-স্মরণানুষ্ঠান, ২৬ থেকে ২৯ জুন। উদ্বোধনে ছিলেন ব্রাত্য বসু-সহ বিশিষ্টজন, পরে সাহিত্যিকদের কথালাপ: এ কালের দৃষ্টিতে বঙ্কিমচন্দ্র। পরবর্তী দিনগুলিতেও ছিল প্রাসঙ্গিক আলোচনা; এ ছাড়াও নানা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর নিবেদনে বঙ্কিম-আশ্রয়ী শ্রুতিনাটক, বঙ্কিমচন্দ্রের গান, স্কুলপড়ুয়াদের উপস্থাপনায় বঙ্কিম-ভাবনায় সমাজচেতনা ও স্বাদেশিকতার চিত্রায়ণ। ছবিতে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা বঙ্কিমচন্দ্রের চিঠি, আমন্ত্রণপত্র থেকে।
শতবর্ষে পা
প্রত্যক্ষ কর অনুশীলনকারী আইনজীবীদের কল্যাণার্থে শ্যামলাল সরকার ভূতনাথ কর শশী ভৌমিক অমৃতলাল মজুমদার এবং জ্ঞানরঞ্জন রায়— বিশ শতকের কলকাতার এই পাঁচ প্রবীণ আইনজীবী ১৯২৪ সালের এপ্রিলে স্কটিশ চার্চ কলেজের কাছে, বিডন স্ট্রিট ইনকাম ট্যাক্স অফিস বিল্ডিংয়ের মধ্যে একটি ছোট্ট ঘরে গড়ে তোলেন ‘ইনকাম ট্যাক্স বার অ্যাসোসিয়েশন, ক্যালকাটা’ নামে একটি সমিতি— দেশের মধ্যে প্রথম। কালে কালে পেরিয়েছে এক শতক, প্রাচীন এই সংস্থাটি দাঁড়িয়ে শতবর্ষের দোরগোড়ায়। সেই উদ্যাপনেরই শুভ সূচনা হল ২৩ জুন, রোটারি সদনে। ‘সমাজে প্রত্যক্ষ করের প্রভাব’ বিষয়ে এক আলোচনারও আয়োজন হয়েছিল, ছিলেন অম্লান ত্রিপাঠী সিদ্ধার্থশঙ্কর সাহা গৌরব জালান সজ্জনকুমার তুলসিয়ান হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়-সহ বিশিষ্টজন।
বিবর্তন নিয়ে
সাঁইত্রিশ বছরে পড়ল ‘নোভা’— পূর্বতন ‘কলকাতা বিজ্ঞান ও সাস্কৃতিক সংস্থা’— সমাজজীবনে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরিই লক্ষ্য যাদের। সাম্প্রতিক কালে কোনও আলোচনা ছাড়াই কখনও জীবনবিজ্ঞান পাঠ্যবই থেকে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব, কখনও রসায়ন থেকে পর্যায় সারণি বাদ পড়েছে। তা মাথায় রেখেই এক বিজ্ঞান-আলোচনার আয়োজন, আগামী কাল ২ জুলাই সকাল ১০টায়, বালিগঞ্জ ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের রাজা শ্রীনাথ হলে। ডারউইন-চর্চা, পর্যায় সারণি ও বিবর্তন-গবেষণার নতুন দিগন্ত নিয়ে বলবেন তিন বিশিষ্ট বিজ্ঞান গবেষক মানস প্রতিম দাস শান্তনু দত্ত ও তুষার চক্রবর্তী, সভাপতিত্বে বেথুন কলেজের শিক্ষিকা সীমন্তি ঘোষ। ছাত্রছাত্রীরা যেন কখনও বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবোধের চর্চায় নিরস্ত না হয়, সেটাই উদ্দেশ্য সভার।
নৃত্যভাষ
২০১৪ সালে পথ চলা শুরু ‘দমদম রিদমস্কেপ’-এর। নৃত্যশিল্পী ও শিক্ষক অনুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই প্রতিষ্ঠানটি কেবল এক ‘নাচের স্কুল’ নয়, ভরতনাট্যম রাবীন্দ্রিক লোকনৃত্য ও সৃজনশীল নৃত্যধারার ব্যাকরণ-প্রকরণ শেখার মধ্য দিয়ে এই সময় ও সমাজকে ছোঁয়ার চেষ্টা। মহানগর ও কাছে-দূরের নৃত্যোৎসাহী শিক্ষার্থীদেরই নয় শুধু, আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকলের কাছে পৌঁছতে চেয়েছে এই প্রতিষ্ঠান— অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদেরও নৃত্যভাষায় কাছে টানতে সফল হয়েছে। রিদমস্কেপ-এর দ্বিবার্ষিক নৃত্যানুষ্ঠান ‘নির্বাণ’ এদের সবার আত্মপ্রকাশের মঞ্চ। আজ, ১ জুলাই রবীন্দ্র সদনে বিকাল ৫টা থেকে ‘নির্বাণ ২০২৩’, কোভিডকাল পেরিয়ে মঞ্চে। দমদমের অনাথাশ্রম ‘আশিয়ানা’-র পঁচিশ জন শিশু-সহ অনুশ্রীর নৃত্যশিক্ষার্থীদের নিবেদন।
ফরাসি ছবি
ফরাসি নবতরঙ্গের তুঙ্গমূর্হূতে আবির্ভাব জাক দেমি-র, অথচ তাঁর সমসাময়িক ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, কিংবা জঁ-লুক গোদারের থেকে আলাদা তাঁর ছবির জগৎ: মেলোড্রামা থেকে মিউজ়িক্যাল, ফ্যান্টাসি, স্টোরিবুক রোম্যান্স— সব কিছু থেকে শিল্পরস নিংড়ে গড়ে তুলেছে নিজস্ব স্বাক্ষর। ষাট থেকে আশির দশক জুড়ে তৈরি তাঁর কাহিনিচিত্রগুলি ফরাসি সিনেমার দিগন্তকে করেছে প্রসারিত। এ বার কলকাতায় বসে তাঁর ছবি দেখার সুযোগ, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ় ও সিনে সেন্ট্রাল-এর একত্র আয়োজনে। আজ ও আগামী কাল, ১-২ জুলাই নন্দন-৩’এ বিকেল ৫টা থেকে দেখা যাবে ১৯৬৪-র কান ফিল্মোৎসবে সেরা ছবির শিরোপাজয়ী দি আমব্রেলাজ় অব চেরবুর্গ-সহ মোট তিনটি ছবি।
আজ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও উত্তর-পূর্বের নানা জায়গা এবং পড়শি দেশ থেকেও মানুষ কলকাতায় চিকিৎসা করাতে আসেন। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের শুরুতেও এ শহরে চিকিৎসা পরিকাঠামো বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। পর্যটক আলেকজ়ান্ডার হ্যামিলটন-এর লেখায় জানা যায়, ইউরোপীয়দের মধ্যে মৃত্যুহার ছিল খুব বেশি। সাহেব ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, কলকাতায় কোম্পানির একটি হাসপাতাল আছে, অনেকেই সেখানে চিকিৎসা করাতে যান। তবে সেখানকার ব্যবস্থাপত্র কেমন তার বর্ণনা দিতে ফিরে আসেন কম জনই!
এমনটা হবে না-ই বা কেন। হ্যামিলটনের প্রায় এক শতক পরেও শহরে বিভিন্ন রোগে যে নিদান দেওয়া হত, শুনলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। পেটের অসুখে ব্যবহার হত ‘অ্যান্টিমনিয়াল ওয়াইন’ নামে এক ধরনের পানীয়। বহুল প্রচলন ছিল পারদ ব্যবহারের। খিঁচুনি, এমনকি আমাশয়ের মতো অসুখেও শরীর থেকে খানিকটা রক্ত বার করে দেওয়া হত, কখনও কোনও অস্ত্রের সাহায্যে, কখনও জ্যান্ত জোঁকের ব্যবহারে! ১৮৩২ সালে কলকাতার জেনারেল হাসপাতালের (ছবিতে, উইলিয়াম উড-এর উনিশ শতকীয় লিথোগ্রাফে) সহকারী সার্জেন উইলিয়াম টোয়াইনিং যে রোগব্যাধি ও তার চিকিৎসার সঙ্কলন প্রকাশ করেন, সেখানেও দেখা যাচ্ছে ‘ডিসেন্ট্রি’-র যন্ত্রণা উপশমে ডজনখানেক জোঁক লাগিয়ে দেওয়ার পরামর্শ। অস্ত্রোপচারের সময় রোগীকে অজ্ঞান করার জন্য ‘মেসমেরিজ়ম’ তথা সম্মোহন গোছের এক পদ্ধতি ব্যবহার করে অপারেশন করার জন্য ১৮৪৬-এ জেমস এসডেল খোলেন ক্যালকাটা মেসমেরিক হসপিটাল। কিন্তু এই পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে ওঠা বিতর্ক এবং আরও নানা কারণে বেশি দিন চলেনি প্রতিষ্ঠানটি।
অন্য দিকে বহু সাধারণ মানুষ ভরসা করতেন আয়ুর্বেদ ও ইউনানি পদ্ধতির দেশীয় চিকিৎসকদের। কুমোরটুলি, শোভাবাজার, কলুটোলার মতো এলাকায় এই চিকিৎসকেরা পরিষেবা দিতেন। আজও উত্তর ও মধ্য কলকাতার কিছু পুরনো এলাকায় হঠাৎ কোনও বাড়ির পরিচয়ফলকে চোখে পড়ে সেই সব মানুষের নাম আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শহরের এক টুকরো হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। এমনকি ডাক্তার-কবিরাজদের পাশাপাশি ছোটখাটো ফোঁড়া কাটার কাজ করতেন নাপিতরাও, সস্তায় ‘পরিষেবা’! ইশ্বর গুপ্তের কবিতায় ‘যদুর-মা’ নামে এক মহিলার কথা আছে, যিনি নাকি ডাক্তারের থেকেও ভাল করতেন এই কাজ। আজও শহরের ফুটপাতে ব্যথার তেল থেকে চোখ বা দাঁতের ব্যথার উপশমে কত কিছু ফেরি করেন এক দল মানুষ। সে সব মলম আর তেলকে ‘ওষুধ’ বলা যাবে না কোনও ভাবেই, তবু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে তার বিক্রিবাটার বহরও বড় কম নয়।
কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের পর পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতির প্রভাব বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে তা-ই হয়ে ওঠে শহরের মূল চিকিৎসা ব্যবস্থা। বহু চিকিৎসক রোগ উপশমে আত্মনিয়োগ করে বিখ্যাত হলেন, আবার অনেকেই রয়ে গেলেন অখ্যাত। আজ ‘চিকিৎসক দিবস’, ধন্বন্তরিপ্রতিম ডাক্তার-বৈদ্যদের স্মরণের পরে এ শহরের কম জানা চিকিৎসা-ইতিহাসও একটু খুঁজে দেখলে মন্দ কী!
প্রেরণা
২৭ জুন চলে গেল— হেলেন কেলারের জন্মদিন। শরীর-মনে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষেরই নয় শুধু, সবার প্রেরণা তিনি। পঁচিশ বছর হেলেন কেলারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ভিক্টোরিয়া হুগো, সেই সব স্মৃতি নিয়ে লিখেছিলেন একটি বই, রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ’ অ্যাকাডেমি নরেন্দ্রপুর থেকে ১৯৮৩ সালে বেরিয়েছিল তৎকালীন আশ্রমাধ্যক্ষ স্বামী অসক্তানন্দের উদ্যোগে। চল্লিশ বছর পর, হেলেন কেলারের ১৪৪তম জন্মবার্ষিকীতে পুনর্মুদ্রিত হল সেই বই— হেলেন কেলার’স রিফ্লেকশনস। সেই সঙ্গে ২৭ জুন রাজ্য সরকারের নারী ও শিশু কল্যাণ এবং সমাজকল্যাণ বিভাগের উদ্যোগে নরেন্দ্রপুর ব্লাইন্ড বয়েজ়’ অ্যাকাডেমিতে পালিত হল ‘শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দিবস’ও: শহরের নানা স্কুলের দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের নিয়ে ক্লে মডেলিং ও ঘ্রাণ-দক্ষতা প্রতিযোগিতা, গান আবৃত্তি শ্রুতিনাটকে; আলোচনায়। ছবিতে ১৯৫৫ সালে ক্যালকাটা ব্লাইন্ড স্কুলে হেলেন কেলার (বাঁ দিকে)।
ইতিহাস ছুঁয়ে
“সুভাষজি, সুভাষজি, উও জান-এ-হিন্দ আ গয়ে/ হ্যায় নাজ় জিসপে হিন্দ কো, উও শান-এ-হিন্দ আ গয়ে...” আজাদ হিন্দ ফৌজের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই শব্দগুলো স্রেফ এক গানের বাণী বললে ভুল হবে, ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক পুরোধাপুরুষের জয়গান তা। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর ও সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মের একশো পঁচিশ বছর উদ্যাপন মাথায় রেখে কলকাতার নাট্যগোষ্ঠী ‘কার্টেন কল’ এ বার মঞ্চে আনছে নেতাজি ও আইএনএ-র প্রেক্ষাপটে নতুন নাট্যপ্রযোজনা— নিতান্ত ব্যক্তিগত। আইএনএ-র ‘ঝাঁসির রানি রেজিমেন্ট’-এর পাঁচ অকুতোভয় ‘রানি’র ব্যক্তিগত বয়ানে গড়ে উঠেছে নাটকের শরীর; লিখেছেন সৌনাভ বসু, সিনোগ্রাফি শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের, নির্দেশনায় তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায়— দেখা যাবে আজ অ্যাকাডেমি মঞ্চে, আগামী কাল ২ জুলাই মধুসূদন মঞ্চে সন্ধ্যা ৬টায়। ১৯৪৩-এর ১২ জুলাই এই বাহিনী গড়ার ঘোষণা করেন নেতাজি, এগিয়ে আসছে সেই দিনটিও। ছবিতে ঝাঁসির রানি বাহিনী পরিদর্শনে নেতাজি।
বিজ্ঞান শিক্ষায়
এক শালিক দেখা বা ১৩ সংখ্যাটা অপয়া নয়। হাঁচি, টিকটিকি, বারবেলা নিয়ে চিন্তা, সেও কুসংস্কার ছাড়া কিছুই নয়। প্রগতির জন্য এদের দূরীকরণ আবশ্যক। করবে কে? শিক্ষিত, কুসংস্কারমুক্ত নাগরিক, বিশেষত ছাত্ররা— বিজ্ঞানের আলো দিয়ে দেশকে যুক্তিবাদী করে তোলার কাজ তাদেরই। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই সাতান্ন বছর আগে ‘অল ইন্ডিয়া সায়েন্স টিচারস অ্যাসোসিয়েশন’-এর পথ চলা। পশ্চিমবঙ্গ শাখাটির বয়সও পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই। ১৮ জুন হয়ে গেল সংস্থার বার্ষিক সম্মেলন, তৃতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণির বহু ছাত্রছাত্রী পুরস্কৃত হল নানা প্রতিযোগিতা ও ‘ট্যালেন্ট সার্চ’ পরীক্ষায়। পরিবেশকে কী ভাবে সঙ্গে নিয়ে চলবে এই প্রজন্ম, তা ওদের বুঝিয়ে বললেন বিজ্ঞানের মাস্টারমশাই আর দিদিমণিরা।