বস্তির ঘরের উপরে এ ভাবেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে নির্মীয়মাণ বহুতলের
বেআইনি বাড়ি ওঠে। ব্যবহার হয় নিম্ন মানের মালমশলা। ভেঙে পড়ে হতাহত হন মানুষ। কিছু দিন নিয়মমাফিক হইচই। তার পরে ফের চেনা ছবি ফেরে কলকাতায়।
সব দেখেশুনেও অবৈধ বাড়ি তোলা বন্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুরসভা? খোদ মেয়রেরই যুক্তি— ‘‘আর্থ সামাজিক দিক ভেবে অনেক সময় আমরা কিছু করতে পারি না।’’ এখন তিনি আবাসনমন্ত্রীও।
মঙ্গলবার ভোরে নারকেলডাঙা ক্যানাল ইস্ট রোডে একটি পাঁচতলা অবৈধ নির্মাণ ভেঙে তিন জন জখম হওয়ার পরে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তা হলে কি আর্থসামাজিক দিক দেখতে গিয়ে কেউ হতাহত হলেও কিছুই করার নেই? মেয়রের জবাব ‘‘লাগামছাড়া হলে তখন তো অ্যাকশন নিতেই হয়।’’
এ দিন ভোরে একপ্রস্ত ঝড়জলে বাড়িটি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে পাশের বাড়ির অ্যাসবেস্টসের ছাদে। টালি ভেঙে জখম হন এক প্রতিবন্ধী শিশু-সহ তিন জন। এলাকাবাসীর দাবি, একে বেআইনি, তার উপর নিম্ন মানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি হচ্ছিল বাড়ির ইটের কাঠামো। তাঁদের অভিযোগ, গত দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই বাড়িটি যে ‘বেআইনি’ ভাবে তৈরি হচ্ছে, তা জানা ছিল পুরসভা ও পুলিশের। তবুও তা বন্ধে উদ্যোগী হয়নি প্রশাসন।
বাড়ি ভাঙার খবর পেয়ে এ দিন ঘটনাস্থলে যান স্থানীয় ৩ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান অনিন্দ্যকিশোর রাউত। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, পুরো বাড়িটিই বেআইনি ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এবং পুর-প্রশাসন বাড়ির প্রোমোটারের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগও দায়ের করেছে। তার প্রেক্ষিতে এ দিন অভিযুক্ত দুই প্রোমোটার মুরগা আলাউদ্দিন এবং গোপীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বাড়িটি যে অবৈধ ভাবে তৈরি, তা স্বীকার করেছেন পুরসভার মেয়র তথা আবাসনমন্ত্রী শোভনবাবুও। তিনি জানান, গত দু’বছরে দু’বার ওই বাড়িটি নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তার পরেও কেন ওই নির্মাণ রোখা হয়নি? মেয়রের জবাব, ‘‘মানবিকতার কথা ভেবে অনেক সময়ে বেআইনি কাজ হচ্ছে জেনেও অ্যাকশন নিতে পারি না। তবে তা যাতে সীমারেখার বাইরে না যায়, সে জন্য পুলিশের কাছে প্রোমোটারের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়। এ ক্ষেত্রে তা হয়েছিল।’’ আর বিল্ডিং দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, কিছু এলাকায় বেআইনি নির্মাণ এত বেশি, যে সেখানে অ্যাকশন নিতে গেলে মার খেতে হয়। তাই পুলিশে অভিযোগ করেই চুপ থাকতে হয়।
একাংশ। মঙ্গলবার।
কিন্তু পুলিশে অভিযোগ করেই কি পুর-প্রশাসনের কাজ শেষ হয়ে যায়? তখনই মেয়র শোভনবাবু আর্থসামাজিক প্রসঙ্গ তোলেন।
এ ব্যাপারে কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পুলিশে অভিযোগ দায়ের করে চুপ করে বসে থাকবে পুরসভা? কোনও অ্যাকশন নেবে না? এ কখনও হতে পারে নাকি? এটা ওঁদের ব্যর্থতা। এখন অজুহাত দেখাতে চাইছেন।’’
বিকাশবাবু দাবি করেছেন, তাঁদের আমলে শুধু পুলিশে জানিয়েই চুপ করে থাকেনি পুরসভা। বিল্ডিং দফতরের মেয়র পারিষদ নিজে ঘটনাস্থলে গিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠেছে আরও। ওই বেআইনি নির্মাণে যে সব ইমারতিদ্রব্য ব্যবহার হয়েছে তা-ও নিম্ন মানের বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে মেয়রের বক্তব্য, ‘‘কে কোন মালমশলা দিয়ে নির্মাণ করছেন, তা দেখার কাজ পুরসভার নয়। দেখেও না।’’
কী ঘটেছিল এ দিন?
পুরসভা সূত্রের খবর, নারকেলডাঙা এলাকায় ৪৮ ক্যানাল ইস্ট রোডে ওই বাড়ির পাঁচতলার উপরে ইটের কাঠামো তৈরি হচ্ছিল। সোমবারও ইটের গাঁথনি করা হয়েছে। এ দিন ভোরে সেই গাঁথনিই ভেঙে পড়ে। বাড়ির ঠিক পিছনে হরিজন বস্তিতে থাকেন সুরেন্দ্রনাথ মাঝি। তিনি জানান, ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন তাঁর মা, স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে। ঠিক সেই সময়েই পাশের বাড়ির ছাদ থেকে ছ’ফুট উচ্চতার ইটের কাঠামো ভেঙে পড়ে ঘরের অ্যাসবেস্টসের চালে। দেওয়ালের ধারে শুয়ে ছিল তাঁর সাত বছরের প্রতিবন্ধী ছেলে পূজন। দৌড়ে ঘরে ঢুকে তিনি দেখেন আস্ত ইটগুলি এসে পড়েছে পূজনের মুখের উপরে। বিকট শব্দ করে হাত পা ছুড়ছে সে। সুরেন্দ্র এবং তাঁর স্ত্রী মালতি মাঝি কোনও রকমে ইটের স্তূপের নীচ থেকে পূজনকে বার করেন। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে দমকলের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌছে পাঁচতলার উপরের ওই কাঠামো ভেঙে দেন।
এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচতলা ওই বাড়ির দেওয়ালটি প্রায় দুশো মিটারেরও বেশি লম্বা। তার পুরোটাই একসঙ্গে ভেঙে পড়ায় পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে গিয়েছে সুরেন্দ্রবাবুর বাড়ির পাশেই পেশায় গাড়িচালক কমলনাথ রানার বাড়িও। কমবেশি আহত হয়েছেন তিনি। ছাদের চাঙড় ভেঙে পড়ে আহত হয়েছেন অসুস্থ এক বৃদ্ধা বিমলা দেবীও। সুরেন্দ্রনাথ, কমলনাথদের কথায়, ‘‘যে ভাবে ওই ইটের কাঠামো ভেঙে পড়েছে, তাতে প্রাণহানিও হতে পারত। কপাল জোরে বেঁচে গিয়েছি!’’
নিজস্ব চিত্র