মহড়া: নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করার আগে অনুশীলনে ব্যস্ত রূপান্তরকামীরা। নিজস্ব চিত্র
এঁদের কেউ পেশায় আইনজীবী। কেউ পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরির খোঁজে, আবার কেউ বা স্কুলপড়ুয়া। এঁরা সকলেই জীবনের একটি কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছেন। ‘আমি কে’— এই প্রশ্নের উত্তর এক সময়ে তা়ড়া করে বেরিয়েছে তাঁদের সকলকেই। সমাজের কাছে নিজেদের পরিবর্তনের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণে এখনও প্রতিদিন লড়াই করেন তাঁরা। সেই লড়াইয়ের গল্প বলতেই এই রূপান্তরকামীরা তাই বেছে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’।
রূপান্তকামী মেঘ সায়ন্তন ঘোষ পেশায় আলিপুর দায়রা আদালতের আইনজীবী হলেও তাঁর ধ্যান-জ্ঞান নাচ। রূপান্তরকামীদের নিয়ে তৈরি করেছেন নাচের দল। তাঁদের নিয়েই আগামী রবিবার মঞ্চে প্রাণ দেবেন ‘চিত্রাঙ্গদা’কে। পুরুষালি-প্রতিবাদী-বলিষ্ঠ রাজকন্যা তো বটেই, নৃত্যনাট্যের বেশির ভাগ চরিত্রই ফুটিয়ে তুলবেন মোট ১৫ জন রূপান্তরকামী। তাঁদের সঙ্গে থাকছেন ওড়িশি নৃত্যশিল্পী সঞ্চিতা ভট্টাচার্য।
মণিপুরের পুরুষালি রাজকন্যা তাঁর প্রিয় পুরুষের মন পেতে নারী হয়ে ওঠার ‘বর’ পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আসল পরিচয় জেনে সেই ‘কঠিন নারী’কেই আপন করে নিয়েছিলেন গাণ্ডীবধারী অর্জুন। মেঘ সায়ন্তনের কথায়, ‘‘চিত্রাঙ্গদা তাই রূপান্তরকামীদেরই জীবনের গল্প বলে। আমাদের সত্তাটাই আসল, লিঙ্গ নয়— সেই কথাই বলে চিত্রাঙ্গদা। এক জন রূপান্তকামীর জীবনের ওঠা-পড়ার পুরোটাই যেন এই নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই সমাজের কাছে নিজেদের কথা বলতে এর চেয়ে ভাল ন়ৃত্যনাট্য আর কিছু ছিল না।’’
সমাজে এক প্রকার কোণঠাসা, প্রান্তিক এই যৌন-সম্প্রদায়ের গল্প শোনাতে তাই নৃত্যনাট্যে কিছুটা বদল করেছেন মেঘ সায়ন্তন। তাঁর কথায়, ‘‘নারীর কুরূপ-সুরূপ বলে তো কিছু হয় না। তাই রাজকন্যার দু’টি ভিন্ন রূপের নাম বদলে রাখছি মহাশ্বেতা এবং আলোকলতা।’’ বদলাচ্ছেন মদনদেবও। নিছক দেবতা নয়, মঞ্চে তিনি থাকবেন কসমেটিক সার্জনের সাজে। বাস্তবে রূপান্তরকামীদের যে ভাবে ‘বদলাতে’ সাহায্য করেন চিকিৎসক-মনোবিদেরা, তারই প্রতিভূ হিসাবে থাকছেন তিনি।
‘চিত্রাঙ্গদা’কে সামনে রেখে সমাজের কাছে ‘মানুষ’ হিসেবেও নিজেদের স্বীকৃতি চাইছেন এ শহরের রূপান্তরকামীরা। রাজকন্যার সখী হিসেবে মঞ্চে দেখা যাবে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী আকাশি পাল অথবা স্নাতক উত্তীর্ণ রূপম রায়কে। ১৮ বছরের আকাশি চান, নাচের মাধ্যমেই এ সমাজে আলাদা জায়গা করে নিতে। আর রূপম (যদিও রূপা নামেই বেশি স্বচ্ছন্দ তিনি) বলছেন, ‘‘আমার পরিবার এখনও পুরোপুরি ভাবে আমার পরিচয় জানে না। এ দিনের অনুষ্ঠানে তাঁরাও আসবেন। চাই, চিত্রাঙ্গদার হাত ধরেই তাঁরা আমার সত্তাকে চিনুক। আমি যা, সে ভাবেই আমাকে গ্রহণ করুক।’’
শুধু নাচই নয়, নাচের মঞ্চে সমাজের মূল স্রোতের কৃতীদের সম্মান দিয়ে তাঁদের কাছে টানতে চাইছেন এই রূপান্তরকামীরা। সেই উদ্যোগের প্রশংসা করে রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিংহ বলছেন, ‘‘এই ধরনের প্ল্যাটফর্মে সমাজের সব স্তরের কৃতীদের সম্মান দিয়ে আয়োজকেরা বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন যে, তাঁরা লিঙ্গ নিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট নন।’’ এ ভাবেই ‘চিত্রাঙ্গদা’র হাত ধরে সমাজের আর পাঁচ জনের সঙ্গে ‘মিলতে’ চাইছেন রূপান্তরকামীরা। চাইছেন, নিজেদের প্রতিভার বিচ্ছুরণ সকলের কাছে পৌঁছে দিতে। সমাজের চোখে চোখ রেখে বলতে চাইছেন— ‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী.../ হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি’।