রাস্তা আটকে তৈরি হচ্ছে হাতিবাগান সর্বজনীনের দুর্গা পুজোর প্যান্ডেল। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
কোথাও হাঁটার জায়গা তো নেই-ই, বন্ধ হয়ে গিয়েছে গাড়ি চলাচলের রাস্তাও। কোথাও আবার এলাকার পার্কে ছোটদের খেলা বন্ধ! কারণ, সেই পার্কের মণ্ডপ নেমে এসেছে রাস্তায়। এমন বহু জায়গা রয়েছে, যেখানে অ্যাম্বুল্যান্স বা দমকল পৌঁছনো তো দূর, বাড়িতে ঢোকা-বেরোনোর পরিসরটুকুও ছাড়া হয়নি। ফি-বছর পুজো এলেই দেখা যায় ভোগান্তির এমন চিত্র। কিন্তু চলতি বছরে সেই ভোগান্তির সময় কয়েক মাস বেড়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। পুলিশ-প্রশাসনের হুঁশ নেই। থানায় অভিযোগ করলেও সুরাহা মেলে না। উল্টে পুজোর সঙ্গে অসহযোগিতার ‘অপরাধে’ বাড়ি এসে শাসিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে বলে অভিযোগ।
ভুক্তভোগীদের দাবি, অন্য বছরে যেখানে পার্ক বা রাস্তা দখল করে পুজো মণ্ডপ তৈরির কাজ চলে মেরেকেটে দেড় থেকে দু’মাস, সেখানে চলতি বছরে বহু পাড়ায় কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে মাস চারেক আগে থেকে। কিন্তু কেন? পুজোর উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, এর পিছনে রয়েছে ‘ইউনেস্কো ছোঁয়া’ পাওয়ার প্রতিযোগিতা। একটি বেসরকারি সংস্থা ইতিমধ্যেই শহরের বেশ কয়েকটি পুজোর নাম ঘোষণা করেছে, যেগুলি পরিদর্শনে যেতে পারেন ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা। সেই সব পুজোর মণ্ডপের কাজ ৮ অক্টোবরের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে। যদিও পুজো শুরু তারও ১২ দিন পরে, ২০ অক্টোবর। এই কারণেই অনেকে জুন-জুলাই থেকে মণ্ডপ তৈরির কাজ শুরু করেছেন বলে খবর।
এমনই একটি পুজো বেলেঘাটা ৩৩ পল্লি। সেখানকার হেমচন্দ্র নস্কর রোড এবং সিআইটি রোডের সংযোগস্থলে এ বারও রাস্তা আটকে মণ্ডপ তৈরির কাজ চলছে। গাড়ি যাওয়ার জায়গা নেই। আশপাশের কয়েকটি বাড়ির দরজাও মণ্ডপের কাঠামোয় ঢাকা পড়ে গিয়েছে। পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা পরিমল দে বলেন, ‘‘এ নিয়ে পর পর দু’বার ইউনেস্কোর ছোঁয়া পেতে চলেছি। ৮ অক্টোবরের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবেই। সব শ্রমিক মিলিয়ে দিন-রাত এক করে কাজ চলছে। রাস্তার এক দিক বন্ধ হলেও হেমচন্দ্র নস্কর রোডের অন্য দিক কিন্তু খোলা। সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’’ একই দাবি দক্ষিণ কলকাতার সমাজসেবী সঙ্ঘের। এই পুজোও ইউনেস্কোর প্রতিনিধিদের গন্তব্যের তালিকায় রয়েছে। লেক রোডের উপরে হওয়া এই পুজোর জন্য ৩০ ফুটের রাস্তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ ফুটে। সেখান দিয়েই কোনও মতে চলছে গাড়ি। চাপ পড়ছে পাশের অনিল রায় রোড এবং লেক টেরাসের উপরে। সমাজসেবীর কর্তা অরিজিৎ মিত্রের দাবি, ‘‘প্রতি বারই এ ভাবে মণ্ডপ হয় আমাদের। সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’’ ইউনেস্কোর তালিকায় থাকা, দমদম পার্ক ভারতচক্রের পুজোকর্তা প্রতীক চৌধুরীর আবার দাবি, ‘‘এলাকার বাসিন্দারাই পুজো কমিটির সদস্য। সমস্যা হলে তাঁরা পুজোয় থাকতেন না।’’
তবে, শুধু ইউনেস্কোর তালিকায় থাকা পুজোই নয়, শহর জুড়ে এই মুহূর্তে রাস্তা আটকে পুজোর প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। মুদিয়ালি ক্লাবের পুজোর জন্য যেমন বন্ধ হয়ে গিয়েছে রজনী সেন রোড, এস আর দাস রোড হয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে আসার রাস্তা। একডালিয়া এভারগ্রিনের পুজোর জন্যও সঙ্কীর্ণ হয়ে গিয়েছে ওই অংশের রাস্তা। একই ভাবে রাস্তার উপরে মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে শিকদারবাগান, নলিন সরকার স্ট্রিট, তেলেঙ্গাবাগান, হিন্দুস্থান পার্ক, হিন্দুস্থান ক্লাব ও কুমোরটুলি সর্বজনীনের। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, বছরের পর বছর এ নিয়ে অভিযোগ থাকলেও প্রশাসনের তরফে কড়া নির্দেশিকা জারি করে কেন কত দিন আগে থেকে পুজোর কাজ শুরু করা যাবে, সেই সংক্রান্ত ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর’ (এসওপি) ঘোষণা করা হয় না?
পুলিশ শুধু জানিয়েছে, নগরপাল এবং অন্য পুলিশকর্তারা মণ্ডপ পরিদর্শনে গেলে বিষয়টি দেখে নেওয়া হবে। ‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব’-এর সাধারণ সম্পাদক তথা হাতিবাগান সর্বজনীনের পুজোকর্তা শাশ্বত বসু বললেন, ‘‘পুজোর জন্য রাস্তা তো একটু আটকানো থাকবেই। এলাকার লোক পুজো নিয়ে গর্ব বোধ করেন, তাই সবটাই তাঁরা মানিয়ে নেন।’’