খিদিরপুরে কলেজে তালা দিল টিএমসিপি, পুরমন্ত্রী বললেন, ছোট্ট ভুল বোঝাবুঝি

আড়াই বছর আগে রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যক্ষকে মারধরের ঘটনাকে মুখ্যমন্ত্রী ‘ছোট্ট ঘটনা’ এবং ‘ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভুল’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। বৃহস্পতিবার খিদিরপুর কলেজের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) পরিচালিত ছাত্র সংসদের আন্দোলনকে ‘কয়েক জন ছাত্রের ভুল বোঝাবুঝি’ বলে বর্ণনা করলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:১৬
Share:

অধ্যক্ষ ঘেরাওয়ের পর এক ছাত্রের প্রবেশ। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

আড়াই বছর আগে রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যক্ষকে মারধরের ঘটনাকে মুখ্যমন্ত্রী ‘ছোট্ট ঘটনা’ এবং ‘ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভুল’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। বৃহস্পতিবার খিদিরপুর কলেজের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) পরিচালিত ছাত্র সংসদের আন্দোলনকে ‘কয়েক জন ছাত্রের ভুল বোঝাবুঝি’ বলে বর্ণনা করলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। যদিও পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে, তালা ভেঙে কলেজের ফটক খুলতে হয় পুলিশকে।

Advertisement

কী ঘটেছিল কলেজে? অধ্যক্ষ তৈমুর রহমান বলেন, “সকাল পৌনে দশটা নাগাদ কলেজে এসে দেখি মূল ফটকে তালা লাগানো। তখন ওয়াটগঞ্জ থানায় খবর দিই। বেলা ১২টার পরে পুলিশ এসে তালা ভাঙে, তার পরে ভিতরে ঢুকি।” পুলিশের অনুমান, বুধবার রাতেই কলেজের দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়।

কেন?

Advertisement

ছাত্র সংসদ জানিয়েছে, ওই কলেজে প্রথম বর্ষের কিছু আসন এখনও ফাঁকা থেকে গিয়েছে। সুযোগ পেয়েও যে ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হতে পারেননি, ফাঁকা আসনে তাঁদের সুযোগ দিতে হবে বলে দাবি ছাত্র সংসদের। অথচ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে গত ২৩ অগস্ট প্রথম বর্ষে ভর্তির দিন পেরিয়ে গিয়েছে। তাই দাবি মানা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছিলেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। তাই কলেজে ঢোকার দরজায় তালা লাগিয়ে আন্দোলনে নেমে পড়ে টিএমসিপি।

শিক্ষামন্ত্রী যতই সংযত হতে বলুন না কেন, সংগঠনের মাথায় যতই উপদেষ্টা কমিটি বসানো হোক না কেন টিএমসিপি যে জঙ্গি আন্দোলনের পথ ছাড়তে রাজি নয়, এ দিনের ঘটনায় তা আরও একবার প্রমাণ হয়ে গেল। খোদ মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি টিএমসিপি-র প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে ছাত্র নেতাদের সংযমী হতে বলেননি। বরং রায়গঞ্জ কলেজ থেকে শুরু করে এ যাবৎ বিভিন্ন উপলক্ষে কখনও ‘ছোট ঘটনা’ কখনও ‘দুষ্টু দামাল ছেলে’ বলে তিনি তাঁর প্রিয় ‘ছাত্র-যৌবনে’র প্রতি আস্থা দেখিয়েছেন। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই এ দিন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম খিদিরপুর কলেজের ঘটনাকে ‘কয়েক জন ছাত্রের ভুল বোঝাবুঝি’ মাত্র বলে উল্লেখ করেছেন।

এ ধরনের ঘটনাকে লঘু করে দেখার এই ধারাবাহিক প্রবণতায় রীতিমতো উদ্বিগ্ন শিক্ষাজগত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এমেরিটাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর কথায়, “রাজ্যের কোথাও না কোথাও, কোনও না কোনও কলেজে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সাধারণ ভাবে সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু যখন কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে এটা ঘটছে, তখন সেটাকে লঘু করে দেখানো হচ্ছে।” প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় বলেন, “সরকার বারবার বলছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। কিন্তু টিএমসিপি-র ছাত্ররাই এই কাণ্ড করছেন।”

টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি, সাম্প্রতিক কালে জঙ্গি ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম হোতা শঙ্কুদেব পণ্ডা কী বলেন? তাঁর দাবি, “কোনও গোলমাল হয়নি। কেয়ার টেকার চাবি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই নিয়ে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।” জবাবে প্রাক্তন উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরীর কটাক্ষ, “যাদের ভুল বোঝাটাই হচ্ছে কলেজের মূল ফটকে তালা দেওয়া, তারা ঠিক বুঝলে কত দূর যাবে!” অথচ খিদিরপুর কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ শাহবাজ আলমের কথা থেকে কিন্তু স্পষ্ট, যা ঘটেছে তা ভেবেচিন্তেই ঘটানো হয়েছে। আলমের বক্তব্য, “উন্নয়নের দিক থেকে কলেজ অনেক পিছিয়ে। আর কর্তৃপক্ষকে বারবার সে কথা বলেও কোনও লাভ হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে এই পথ নিয়েছি।”

ছাত্র সংসদের চাপের মুখে এ দিন তাদের মূল দাবির অনেকটাই মেনে নিয়েছেন কলেজ-কর্তৃপক্ষ। অধ্যক্ষ জানান, এ দিন কলেজে পরিচালন সমিতির বৈঠক ছিল। ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ শাহবাজ আলমও উপস্থিত ছিলেন ওই বৈঠকে। ঠিক হয়েছে, যাঁরা সুযোগ পেয়েও কোনও কারণে নির্দিষ্ট সময়ে ভর্তি হতে পারেননি, তাঁরা এই সুযোগ চেয়ে আবেদন জানাবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। সেই আবেদন ‘ফরওয়ার্ড’ করবেন কলেজ-কর্তৃপক্ষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, এমন কোনও আবেদন এলে সিন্ডিকেটে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে।

অথচ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি অধ্যক্ষ-উপাচার্যদের হাতজোড় করে অনুরোধ করেছিলেন, চাপের মুখে তাঁরা যেন মাথা নত না করেন। কিন্তু চাপের উৎসটি নির্মূল না করে করলে কাজের কাজ কত দূর হবে,

সে দিনই তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রবীণ শিক্ষাবিদেরা। তাঁদের আশঙ্কা যে ভিত্তিহীন ছিল না, খিদিরপুর কলেজের ঘটনায় এ দিন ফের তা প্রমাণ হল। শিক্ষাজগতের অনেকেই বলছেন, খাস কলকাতার কলেজেই যদি ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা মূল ফটকে তালা লাগিয়ে চাপ দিয়ে এ ভাবে দাবি আদায় করতে পারে তা হলে জেলার কলেজগুলিতে পরিস্থিতি কেমন, তা সহজেই অনুমেয়। কখনও ছাত্র ভর্তির দাবি, কখনও টোকাটুকির দাবিতে রাজ্যের কলেজে কলেজে গোলমাল লেগেই রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মূল অভিযোগ টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে। কোথাও গোলমালের জেরে অধ্যক্ষ ইস্তফা দিয়েছেন। কোথাও আবার ছাত্র সংসদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কলেজ বন্ধ করে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষই। কলেজ খুলতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে শিক্ষামন্ত্রীকে। দেড় বছর আগে কলকাতার এই খিদিরপুর-গার্ডেনরিচ এলাকাতেই হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র নির্বাচনের দিন বেঘোরে প্রাণ দেন এসআই তাপস চৌধুরী।

খিদিরপুর কলেজের এ দিনের ঘটনার প্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী কী বলবেন? সন্ধ্যায় পার্থবাবু বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে স্থানীয় নেতা এবং পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে সমস্যা মেটানোর জন্য বলেছিলাম। তিনি পরে জানিয়েছেন, ছাত্রদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থেকে একটা সমস্যা হয়েছিল। সেটা মিটেও গিয়েছে।” শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, ফিরহাদকে পাঠানো ছাড়াও পার্থবাবু নিজে কলেজের অধ্যক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement