আবার আত্মঘাতী গোলে মুখ পুড়ল শাসক দলেরই

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি! তফাত সাড়ে ন’মাসের। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে কী ভাবে রাজপথে প্রতিবাদের হাতিয়ারে পরিণত করিয়ে দেওয়া যায়, ফের দেখিয়ে দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলবল!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫৪
Share:

বাম ছাত্র সংগঠনের মিছিল। শিয়ালদহ থেকে কলেজ স্কোয়ারের পথে। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি!

Advertisement

তফাত সাড়ে ন’মাসের। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে কী ভাবে রাজপথে প্রতিবাদের হাতিয়ারে পরিণত করিয়ে দেওয়া যায়, ফের দেখিয়ে দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলবল! যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্ষোভে পুলিশ পাঠিয়ে গোটা ছাত্র ও শিক্ষক সমাজকে পথে নামিয়ে দিয়েছিল মমতার প্রশাসন। আর এ বার তাঁরই দলের ছাত্র সংগঠনের দৌলতে ফের রাস্তায় উত্তাল হল প্রতিবাদ! এমনকী, এই শহরের গণ্ডি ছা়ড়িয়ে অন্যত্রও ছড়িয়ে গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিগ্রহের প্রতিবাদে বিক্ষোভ। একই সরকারের একই নেতা-মন্ত্রীরা বারবার কী ভাবে একই ভুল করতে পারেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে শাসক দলের অন্দরেই!

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আধিকারিকের সাসপেনশনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অবস্থান চালাতে গিয়ে বুধবার তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) হাতে হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন শিক্ষকেরা। রেহাই পাননি উপাচার্য, সহ-উপাচার্যও। তারই প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার মিছিল ও পাল্টা বিক্ষোভে তেতে উঠেছে কলেজ স্কোয়ার। পথে নেমে নানা প্রতিষ্ঠানের একের পর এক শিক্ষক এবং শিক্ষা-ব্যক্তিত্ব শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। মুখ খুলেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নীরবতার বিরুদ্ধেও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস এ দিন অবশ্য নীরবতা ভেঙে বুধবারের ঘটনাকে ‘অনভিপ্রেত এবং কলঙ্কজনক’ আখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘আমি স্পষ্ট করে বলছি, বুধবার যা হয়েছে, তা হওয়া উচিত ছিল না। এই ঘটনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যে আঘাত এসেছে।’’ চাপের মুখে ঈষৎ সুর বদলাতে হয়েছে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কেও। ঘটনার দিন যিনি কার্যত নিগ্রহকারী ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই শিক্ষামন্ত্রীকেই এ দিন বলতে হয়েছে, ‘‘ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক।’’ বলতে হয়েছে, ‘‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য বরদাস্ত হবে না! মুখ্যমন্ত্রীও এটা সমর্থন করেন না।’’

Advertisement

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ঘটনার জল আদৌ কি এত দূর গ়ড়ানোর দরকার ছিল? সেপ্টেম্বর মাসে যাদবপুরের ঘটনার সঙ্গে তুলনা টেনে কেউ কেউ বলছেন, আত্মঘাতী গোলে অদ্ভুত পারদর্শিতা অর্জন করেছে শাসক শিবির। এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগের প্রতিবাদে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থান চলছিল। তৎকালীন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর আর্জিতে সাড়া দিয়ে হঠাৎই মধ্যরাতে পুলিশ পাঠিয়ে অবস্থান ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল। পুলিশের হাতে ছাত্রদের নিগ্রহ জন্ম দিয়েছিল ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের। আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল সরকারের ভিতরে-বাইরে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের সূত্রপাত, এক আধিকারিককে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্তকে ঘিরে। ওই আধিকারিককে ‘বলির পাঁঠা’ করা হয়েছে, এই অভিযোগে কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে অবস্থান চালাচ্ছিলেন শিক্ষক সংগঠন কুটা-সহ যুক্তমঞ্চের সদস্যেরা। তাঁদের উপরেই টিএমসিপি চড়াও হয় বলে অভিযোগ।

যাদবপুরে পুলিশ পাঠিয়ে প্রভূত বিতর্ক এবং প্রতিবাদের পরে শেষ পর্যন্ত উপাচার্য অভিজিৎবাবুকে সরিয়েই দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতার ক্ষেত্রেও আজ, শুক্রবার আন্দোলনকারী যুক্তমঞ্চের সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবুর। দুই ঘটনার সাযুজ্য টেনে শাসক দলেরই এক নেতা বলছেন, ‘‘বারবার আমরা নিজেরাই দেখিয়ে দিচ্ছি, আমরা জল ঘুলিয়ে খেতে পছন্দ করি!’’ তৃণমূলেরই এক প্রাক্তন ছাত্র নেতার মন্তব্য, ‘‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা এমন ঘটনা ঘটাল, তারা ছাত্র আন্দোলন কতটা বোঝে, তা নিয়েই সন্দেহ আছে! এরা তো সিপিএমের পাতা ফাঁদে পা দিল!’’ ওই নেতার যুক্তি, প্রতিবাদী শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের অধিকাংশই বামপন্থী, এটা ঘটনা। কিন্তু কয়েক দিন সেনেট হলের সামনে অবস্থানে বসে থেকে তাঁরা সরকারকে এমন কিছু বিপদে ফেলতে পেরেছিলেন কি? তাঁদের আন্দোলন ভাঙার জন্য হামলা চালিয়ে গোটা বিষয়টাকে বরং ব়ড় প্রতিবাদের অস্ত্র হিসাবে সব মহলের হাতে তুলে দেওয়া হল!

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

যাদবপুরের সঙ্গে কলকাতার একটি তফাত অবশ্য আছে। সেই সময় শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন শঙ্কুদেব পণ্ডা। স্বয়ং দিদির আশীর্বাদ ছিল তাঁর মাথার উপরে। যাদবপুরের পড়ুয়াদের বিশাল মিছিলের পরে পাল্টা মিছিল হয়েছিল ‘শঙ্কুস্যারে’র নেতৃত্বে। শঙ্কু জমানা কাটিয়ে এখন টিএমসিপি-র শীর্ষে এসেছেন অশোক রুদ্র। যিনি আবার তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবুর অনুগামী বলেই পরিচিত! যে কারণে এ বার শিক্ষামন্ত্রীর বিড়ম্বনা আরও বেশি! বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে বুধবার নিজেই হাজির থেকে শিক্ষক-হেনস্থা অভিযানের পাণ্ডা সৌরভ অধিকারীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অশোক। এবং সেখানেই শেষ নয়। ঘটনার প্রতিবাদে যখন শিক্ষক এবং বিদ্বজ্জনেরা এ দিন মুখর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এ দিন ফের সৌরভের নেতৃত্বে ঝান্ডা হাতে মিছিল করেছেন শাসক দলের সমর্থকেরা! বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে বুঝে শেষ পর্যন্ত এ দিন বিকাশ ভবনে অশোককে ডেকে পাঠিয়ে সমঝে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। শাসক দলের এক শীর্ষ নেতা পরে বলেছেন, ‘‘শঙ্কু মহারাজের পথ ধরলে বিপদ হবে, এটা অশোককে বুঝতে হবে!’’

এ দিন সকাল থেকেই ফের বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলের বাইরে অবস্থান করেছেন কুটা-র সদস্যেরা। তাঁদের অবস্থান মঞ্চে আসেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়, প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য ও কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে দাবিপত্র দিয়েছে তৃণমূল-সমর্থিত শিক্ষকদের সংগঠন ওয়েবকুপা-ও। সংগঠনের তরফে কৃষ্ণকলি বসু বলেন, ‘‘বিশ্বদ্যালয়ের ভিতরের পরিবেশ ঠিক করার আবেদন জানিয়েছি। আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা ও অবস্থান তুলে নেওয়ার

দাবি জানিয়েছি।’’ বিকেলে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে মিছিল করে ওয়েবকুটা। কলেজ স্কোয়ারে কুটা, ওয়েবকুটা এবং ডিএসও-র মিছিল এসে পৌঁছয়। অন্য দিকে বিকেল চারটে নাগাদ শিয়ালদহ থেকে এসএফআই এবং ডিওয়াইএফআইয়ের আর একটি মিছিল আসে। তারা কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে অবরোধ করে। প্রায় এক ঘণ্টা পরে অবরোধ উঠে যায়।

প্রতিবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বুঝে এ দিন শঙ্খ ঘোষ থেকে শুরু করে কৃষ্ণা বসু, সুগত বসুদের সঙ্গে কথা বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। পরে পার্থবাবু বলেছেন, ‘‘কড়া হাতে এ সব ঘটনার মোকাবিলা করা হবে।’’ তবে একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের প্রতি তাঁর আক্ষেপ, ‘‘মূল যেটা নিয়ে গোলমাল, একটা দুর্নীতির পাশে দাঁড়িয়ে কেন শিক্ষকেরা আন্দোলন করবেন, সেটা নিয়ে কেউ তো কিছু লিখছেন না!’’ শিক্ষামন্ত্রীর দলেরই এক নেতা অবশ্য বলছেন, ‘‘লেখার জন্য অনেক বড় বিষয় তো আমরাই জুগিয়ে দিয়েছি!’’

আর মুকুল রায় শিবিরের এক নেতার খোঁচা, ‘‘সংখ্যালঘু ভাবাবেগ আছে বলে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাণ্ডবের ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে কড়া মুখ্যমন্ত্রী। আর প্রেসিডেন্সি বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা হলে সব অপপ্রচার!’’ খোদ মুকুল রায়ও সরকারকে বিঁধেই বলেছেন, ‘‘ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় পড়াশোনা করতে। শিক্ষকেরা তাদের কাছে পিতৃসম। সেখানে এমন ঘটনা অনভিপ্রেত।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement