Durga Puja 2022

দারিদ্রের সঙ্গে নিত্য লড়াই এই দুর্গতিনাশিনীর

বছরখানেক আগে সবাই যখন মুখ ঘুরিয়ে নেন, সদ্য তরুণী তিনিই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন মা-বাবা মরা এই শিশুপুত্রের দায়িত্ব। শিশু অনুভবের এই দুর্গতিনাশিনীর আঠারোর জন্মদিন কেটেছিল হাসপাতালে।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:৪৬
Share:

বন্ধন: অনুভবের সঙ্গে অনিতা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

বিয়ে না করেও কর্তব্য আর ভালবাসায় জড়ানো এক মা তিনি। কচি ছেলেটাকে পুজোয় কী দেবেন, ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না। এ দিকে বাঁশ বাঁধা দেখে আধো আধো গলায় নতুন জামার বায়না জুড়েছে ছেলে। ‘‘এটা বায়না নয়। মায়া, পুজোর মায়ায় জড়িয়ে ফেলছে’’— বলে উঠলেন তরুণী মা।

Advertisement

বছরখানেক আগে সবাই যখন মুখ ঘুরিয়ে নেন, সদ্য তরুণী তিনিই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন মা-বাবা মরা এই শিশুপুত্রের দায়িত্ব। শিশু অনুভবের এই দুর্গতিনাশিনীর আঠারোর জন্মদিন কেটেছিল হাসপাতালে। ওই দিনই যমে-মানুষে টানাটানির শেষে অনুভবের জন্ম দিয়েছিলেন তরুণীর মামাতো দিদি। সেই দিদি এবং তাঁর ফুটফুটে ছেলে কোলে হাসিমুখে ফিরেছিলেন বালিগঞ্জের পেয়ারাবাগান বস্তির তরুণী অনিতা দাস।

তবে আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অনুভবের দু’বছর বয়সে মা শিখার জিভে ক্যানসার ধরা পড়ে। একাধিক হাসপাতাল ঘুরে কেমো নিয়ে শুরু হয় চিকিৎসা। লড়াইয়ে বাধা হয় করোনা। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে জ্বর নিয়ে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি হন শিখা। সেখানেই মারা যান। চিকিৎসকেরা জানান, মৃত্যুর কারণ কোভিড। মা-হারা ছেলে আঁকড়ে ধরে বাবা সঞ্জয় মণ্ডলকে। কিন্তু গাড়িচালক সঞ্জয়েরও মৃত্যু হয় কোভিডে। তিনি শম্ভুনাথ পণ্ডিতের করোনা ওয়ার্ডে গত বছরের ২৮ জুলাই মারা যান।

Advertisement

১০ মাসের ব্যবধানে বাবা-মাকে হারানো ছেলের দায়িত্ব নিতে চাননি আত্মীয়েরা। কেউ বলেছেন, ‘‘ছেলে-মেয়েকে দেখতেই নাকাল হচ্ছি, আরও এক জন!’’ কেউ বলেছেন, ‘‘রোজগার বন্ধ। খাওয়াব কী!’’ বছর বাইশের অনিতা কিন্তু এত কিছু ভাবেননি। দক্ষিণ কলকাতার এই কলেজপড়ুয়া তরুণীর তখন সম্বল টিউশন পড়ানোর টাকা। অনুভবের দায়িত্ব নিয়ে রাতদিন ছাত্র পড়াতে শুরু করলেন। কলেজে অনিয়মিত হলেন তিনি। পাশে দাঁড়ালেন শিক্ষকেরা। ছাত্র পড়িয়ে অনিতার মাসে আয় সাড়ে ছ’হাজার টাকা। তাই দিয়েই গড়েছেন অনুভবের ‘খেলাঘর’। অনিতা বলেন, ‘‘খেলাঘর ছাড়া কী? খেলনা ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি। পুজোয় একটাই জামা-প্যান্ট দিলাম। বড় হচ্ছে, একটু একটু ইচ্ছে জাগছে। ছোটদের সরকারি স্কুলে দিয়েছি। ভাল স্কুলে ওকে ভর্তি করতে চাই। আমার ইচ্ছে, বড় হয়ে ডাক্তার হোক।’’

ছেলেকে একটু ভাল করে রাখতে সদ্য স্নাতক উত্তীর্ণ অনুভবের ‘অনিতা’ চাকরির খোঁজে একাধিক জায়গায় দিয়ে রেখেছেন সিভি। উত্তর মেলেনি। হ্যাঁ, অনিতাকে নাম ধরেই ডাকে একরত্তি। তরুণী বলছিলেন, ‘‘সারা দিন আমায় অনিতা ডাকে। রাতে ঘুমের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মা বলে। সেই ভাল লাগা বোঝানোর নয়।’’

অনিতার সংসার বলতে বস্তির দশ ফুট বাই বারো ফুটের টিনের চালাঘর। মা আর অনুভবকে নিয়ে সেখানেই থাকেন অনিতা। আসবাব বলতে একটি চৌকি আর অচল টিভি। চৌকির নীচে রান্নাবান্নার আয়োজন। উপরে ছড়ানো খেলনা। সব নিয়ে এক মনে ঘর বানানোর চেষ্টা করছে অনুভব। পাশে শুয়ে অনিতার মা। সদ্য তাঁর চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে।

অনুভবের সম্পত্তি হাতড়ে অনিতাই দেখালেন, পায়ে দড়ি বাঁধা একটি মুরগি। একগাল হেসে বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল একরত্তি, ‘‘ওর নাম ছোটকা। আর একটা বড়কা। ওটা বাইরে ঘুরছে। আমি ডিম ভাল খাই। ৪৩টা ডিম দিয়েছে।’’ আধো কথায় ঘরে হাসির রোল উঠলেও হাসি নেই অনিতার। বললেন, ‘‘মাঝেমধ্যেই মাংস খেতে চায়। খাওয়াতে পারি না। রোজ ডিম কিনে খাওয়ানোই কঠিন। পাড়ার এক জন ওকে দুটো মুরগি দিয়েছেন। এরাই খেলার সঙ্গী।’’

বিয়ে করবেন না? তরুণীর উত্তর, ‘‘অনুভবের বাবা বলেছিল, ছেলেটা একটু দাঁড়ালে বিয়ে করিস। যত দিনে বিয়ে করব, অনুভব মানুষ হয়ে যাবে। আর বিয়ে করলেও কি ফেলে দেওয়ার সম্পর্ক? আমিই যে ওর মা।’’

নীল ঝকঝকে আকাশ, মণ্ডপের চূড়ান্ত প্রস্তুতি, হাল্কা মেজাজি আড্ডায় বাতাসে আগমনীর বার্তা। কিন্তু পিছনে ফেলে আসা পেয়ারাবাগান বস্তির ওই চালাঘরে যিনি, তিনি কে? কানে ভাসছিল ভালবাসার দাবি, ‘আমিই যে ওর মা।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement