ডেঙ্গি সচেতনতায় পোস্টার বরাহনগরে। নিজস্ব চিত্র।
ডেঙ্গির মরসুমে আক্রান্তদের বিষয়ে তথ্য গোপনের অভিযোগ আগেও উঠেছে। স্থানীয় পুরসভা ও স্বাস্থ্য দফতরের চাপেই বহু ক্ষেত্রে সংক্রমিতের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ্যে আসে না বলে দাবি চিকিৎসক মহলের একাংশের। এ বছরেও যখন রাজ্যে প্রতিনিয়ত ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ছে, তখন চিকিৎসকদের একাংশেরই অভিযোগ, শহর থেকে জেলায় যত জন আক্রান্ত হচ্ছেন, তত জনের তথ্য প্রকাশ্যে আসছে না। আর তথ্য গোপনের এই প্রবণতাই জনস্বাস্থ্যের পক্ষে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা।
অভিযোগ পুরোপুরি না মানলেও স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা এটা মানছেন যে, অনেক সময়েই দেখা যাচ্ছে, তাঁদের সঙ্গে পুরসভার দেওয়া পরিসংখ্যানে অনেকটা ফারাক থাকছে। যার ফলে সংশয় তৈরি হচ্ছে আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে। সাম্প্রতিক কালে কলকাতা ও শিলিগুড়ি পুরসভা এলাকাতেও ডেঙ্গি আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকদের একাংশ। সংশয় রয়েছে অন্যান্য পুরসভা ও ব্লকের ক্ষেত্রেও। কারণ, পুরসভার তরফে যে সংখ্যা বলা হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য মিলছে না। এমন অভিযোগও উঠেছে, যে পরিসংখ্যান জানা যাচ্ছে, তার পুরোটা সামনে আনতে চাইছে না সরকার। সেই কারণেই তথ্যে ফারাক তৈরি হচ্ছে।
তথ্য না পেলে সমস্যা যেখানে
• সময় মতো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
• ডেঙ্গিপ্রবণ এলাকা আলাদা করে চিহ্নিত করে মশার বংশবিস্তার রোধ এবং উৎস খুঁজে বার করার কর্মসূচি ব্যাহত হয়।
• জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানের নিরিখে যথাযথ পদক্ষেপ বিঘ্নিত হয়।
• মানুষও সাবধান হন না।
• আগামী দিনের পরিকল্পনা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
• যার ফলে ভবিষ্যতে আবার একই বিপদ আসতে পারে।
বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠনের দাবি, কোভিডের দৈনিক বুলেটিনের মতো ডেঙ্গির পরিসংখ্যানও প্রকাশ্যে আনা প্রয়োজন। এক প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, ‘‘সংক্রামক রোগের প্রকোপ আটকাতে মানুষের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই দৈনিক কত জন আক্রান্ত হচ্ছেন, তা সাধারণ মানুষেরও জানা প্রয়োজন। তাতে অন্তত বাস্তব চিত্রটা উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদেরও পদক্ষেপ করতে সুবিধা হবে।’’ ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর সাধারণ সম্পাদক, চিকিৎসক মানস গুমটা বললেন, ‘‘তথ্য গোপন করা এই রাজ্যে নতুন নয়। কোভিডের সময়েও মৃত্যু কম দেখাতে আইসিএমআর এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অস্বীকার করে কোমর্বিডিটির তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছিল এ রাজ্যেই। অতীতে ডেঙ্গিতে যখন বহু মানুষ মারা যাচ্ছিলেন, তখনও অজানা জ্বরের তত্ত্ব আনা হয়েছিল। ডেঙ্গি পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে সত্যি কথা বলায় দীর্ঘদিন সাসপেন্ড ছিলেন এক চিকিৎসক।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আশ্চর্যের বিষয়, জনস্বাস্থ্যের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত এক আধিকারিক প্রশাসনিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে জেলায় জেলায় ডেঙ্গি নিয়ে বৈঠক ডেকে সেখানে মেডিক্যাল কাউন্সিলের নির্বাচনের প্রচার করে বেড়াচ্ছেন।’’
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ডেঙ্গিতে আক্রান্তের তথ্যের ভিত্তিতেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা তা নির্মূল করার পথ নির্ধারণ করেন। সেখানে তথ্য গোপন করার অর্থ, মানুষের জীবন নিয়ে খেলা। স্বাস্থ্য দফতরের জনস্বাস্থ্য বিভাগের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, পরিস্থিতি যে ভাবে দ্রুত পাল্টাচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যাচ্ছিল, প্রকৃত তথ্য পেতে কিছু জায়গায় সমস্যা হচ্ছে। আক্রান্তের খোঁজ মিললেও তা স্বাস্থ্য দফতর জানতে পারছে না। তবে তা বেসরকারি হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি এবং চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারেই বেশি হচ্ছিল। ওই আধিকারিক বলেন, ‘‘বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার পরেই সমস্ত বেসরকারি ক্ষেত্রকে সতর্ক করা হয়েছে।’’ তিনি জানান, স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, জ্বরে আক্রান্ত রোগীর ডেঙ্গি চিহ্নিত হওয়া এবং হাসপাতালে ভর্তি থেকে ছুটি পর্যন্ত সমস্ত তথ্য স্বাস্থ্য দফতরের নির্দিষ্ট পোর্টালে প্রতিদিন আপলোড করতে হবে। যাতে দৈনিক খবর দফতরের কাছে থাকে।
কিন্তু চিকিৎসকদের একাংশের প্রশ্ন, আদৌ কি মশাবাহিত রোগে আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে? না কি বিপর্যয় ঢাকতে তথ্য গোপন চলবেই!