প্রতীকী ছবি।
থিয়েটার বন্ধ হতে পারে না! দু’জন থাকলেও থিয়েটার হবেই। এমনটাই মনে করেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত।
শুনতে শুনতে লকডাউন-পর্বের গোড়ায় সপরিবার কৌশিক-রেশমি-ঋদ্ধি সেনদের অভিনয়ে ছোট্ট ভিডিয়ো-ছবির কথা মনে পড়ছিল। দমবন্ধ, ঘরবন্দি দশায় পরপর ড্রয়িংরুম পারফরম্যান্সে স্বামী-স্ত্রী হয়ে উঠছেন ওথেলো-ডেসডিমোনা বা পিতা-পুত্র ডিএল রায়ের আওরঙ্গজ়েব-মহম্মদ। শিবপ্রসাদ-নন্দিতাদের আয়োজনে সেই ছবি যে কোনও নাট্যকর্মীরই যন্ত্রণার দলিল।
করোনা-ধাক্কায় কাজ হারিয়ে নিষ্ক্রিয় থাকার চার মাস হতে চলল। এর মধ্যে সিরিয়ালের শুটিং ছন্দে ফিরলেও গাঢ় হচ্ছে থিয়েটার জগতের হতাশা। সিনেমা থেকে সঙ্গীতজগৎ ঘোর সঙ্কটের শিকার। তবু তাদের জন্য কিছু বিকল্প মাধ্যম রয়েছে। কিন্তু দর্শকদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছাড়া থিয়েটারের আত্মপ্রকাশের পথ আছে কি না, ঘোর সন্দেহ! “রাজ্য সরকার এত দুর্যোগেও নাট্যকর্মীদের ভোলেনি”— বলছেন মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। রাজ্যের ৩০০টি নাট্যদলের জন্য তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান তাদের অ্যাকাউন্টে ঢুকতে শুরু করেছে। নাট্য অ্যাকাডেমির উপদেষ্টা বিজয় মুখোপাধ্যায়ের দাবি, কেন্দ্রীয় অনুদান পায় না এমন দলগুলিই আবেদনের ভিত্তিতে এই বার্ষিক অনুদান পাচ্ছে।
তবে বিভিন্ন দলের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে কাজ করা অভিনেতা ও নেপথ্যকর্মীরা সেই উপেক্ষিতই রয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করেন বিমল চক্রবর্তী, সীমা মুখোপাধ্যায় থেকে মনীষা আদক, সুমন পাল, সৌরভ পালধীর মতো বিভিন্ন প্রজন্মের নাট্যকর্মীরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠিতে দুঃস্থ শিল্পী-কলাকুশলীদের আর্থিক সুরক্ষা দেওয়ার (মাসিক ভাতা, চিকিৎসা বিমা) আর্জিতে সই করেছেন প্রবীণ অরুণ মুখোপাধ্যায়, হরিমাধব মুখোপাধ্যায় থেকে রাজ্যের কয়েকশো নাট্যকর্মী।
নানা বিষয়ে মতান্তর থাকলেও দুঃস্থ নাট্যকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে লকডাউন-পর্বটি ঐক্যেরও স্মারক। আমপানের পরে বিভাস চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, নাট্যকার চন্দন সেনেরা মাঠে নেমেছেন। ব্রাত্য বসু, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, দেবশঙ্কর হালদার বা কৌশিক সেনেরা নাট্যকর্মীদের কল্যাণে নানা উদ্যোগের শরিক। এই পর্বে তরুণ নাট্যকর্মীরা রুজির আশায় বাড়ি-বাড়ি নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন। কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ পর্যন্ত করছেন। আবার প্রবাসী, সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালিদের থেকে সাহায্য পেতে অনলাইন অনুষ্ঠানও করছেন শিল্পী-নাট্যকর্মীরা।
নাট্যকর্মী-সাংসদ অর্পিতা ঘোষের মতে, “নাট্যকর্মীদের একজোট হওয়া ইতিবাচক। তবে করোনা-পরবর্তী সময়ে বড় প্রোডাকশনের বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ আছে। নেপথ্যকর্মী, কলাকুশলীদের অনেকের ভবিষ্যৎ নিয়েও সঙ্কট তৈরি হতে পারে।” অনেক দলই একক বা গুটিকয়েক শিল্পী নিয়ে অভিনয়ের কথা ভাবছে। মিনার্ভা রেপার্টরির মহড়ায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পালা করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। পানিহাটির পাইন ঠাকুরবাড়ির দোলতলায় ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ করেছে ‘বেলঘরিয়া হাতেখড়ি’। সেট নিয়ে ঝামেলা নেই। মন্দিরের পরিবেশ নাটকের সঙ্গে মিলে গিয়েছে। সীমিত সংখ্যক দর্শকদের জন্য সতর্কতাও যথেষ্ট।
দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “কঠিন সময়টাই থিয়েটারের নতুন রাস্তা খোঁজার সময়।” জনপরিসরের নানা জায়গা থিয়েটার এখন অধিকার করতে পারে। কৌশিক বলছেন, “থিয়েটারে বিমূর্ততার নানা সম্ভাবনা রয়েছে। সীমিত পরিকাঠামোয় কল্পনার জোরে কাজেরও এটাই সময়।” এক সুর ব্রাত্যেরও। তবে তিনি বলছেন, “আসলে আর সবার মতো থিয়েটারও কিন্তু ভাইরাসের প্রতিষেধকই খুঁজছে।”
এই দুঃসময়েও থিয়েটারকে ঘিরে স্বপ্নগুলো বন্ধ হয়নি। সৌমিত্র মিত্রেরা শো না-হওয়ার যন্ত্রণা থেকে দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যাত্রা ভিডিয়োয় তুলছেন। তরুণতর প্রজন্মের তূর্ণা দাস বলছিলেন, “মুখোমুখি দর্শক ছাড়া থিয়েটার হওয়া মুশকিল। তবে নানা পারফরম্যান্স হচ্ছে। থিয়েটারের শিক্ষা বৃথা যাচ্ছে না।” মেয়েদের সুরক্ষায় পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ঠাট্টা করে তূর্ণারা চার শিল্পী কিংবা রায়তী ভট্টাচার্যের একটি ভিডিয়ো-উপস্থাপনা নেটদুনিয়ায় সাড়া ফেলেছে।
এই পর্বেই যত্ন নিয়ে শ্যামবাজারের থিয়েটার বিষয়ে তথ্যচিত্র তৈরিতে ব্রতী হয়েছেন সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পৌলমী চট্টোপাধ্যায়দের ‘নীলকণ্ঠ’ নাটকপাঠও থাকবে সেখানে। ‘নহবত’ থেকে পড়বেন রত্না ঘোষাল। ‘বাংলার ব্রডওয়ে’ শ্যামবাজারের নাটকের সৌধ ভেঙে পড়ার ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছেন ব্রাত্য, সোহাগ সেনও।
মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে অতিমারিতে ধ্বস্ত সময়ে গ্রুপ থিয়েটার মঞ্চে ফিরলে দুই-তৃতীয়াংশ ভাড়া কমানোর কথা বলেছেন নাট্যকর্মীরা। অগস্টে সুজয়ের তথ্যচিত্র ‘স্পটলাইট’ মুক্তি পাওয়ার কথা। তিনি বিষণ্ণ, “কী অদ্ভুত সময়! যখন রংমহল-বিশ্বরূপার মতো অ্যাকাডেমি-শিশির মঞ্চও হানাবাড়ির মতো পরিত্যক্ত।” শাপভ্রষ্ট অহল্যার মতো থিয়েটারের মুক্তির প্রতীক্ষাই যেন শেষ কথা বলে চলেছে।