জয়ী: আমপানের দিন বহু বাধা ঠেলে হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন হবু মা রিয়া। ঝড়ের এক মাস পরে শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে তিনি। নিজস্ব চিত্র
আর ক’টা দিন আমার ভিতরে থাকতে পারলি না! এই ঝড়ের মধ্যে আসার এত কী তাড়া তোর?
গাড়িতে টান-টান বসে দাঁতে দাঁত চেপে এ কথাগুলোই ভাবছিলেন মরিয়া তরুণী। অবিশ্বাস্য সোঁ-সোঁ হাওয়ায় গাড়িটা খেলনার মতো দুলে দুলে উঠছে। শহরের চেনা রাজপথ তখন নদী। তাতে মাঝেমধ্যে ঝিলিক দিচ্ছে বিদ্যুতের ফুলকি।
নামলেই জীবনসঙ্কট। পথ আটকে বিদ্যুতের ওপড়ানো খুঁটি, নারকেল গাছ। হবু মা রিয়া সিংহ তবু গাড়িতে যেতে যেতে যন্ত্রণায় প্রাণ খুলে কাঁদতে পারছেন না। অসহায় বাবা, কাকা, পিসি তাতে যে আরও অসহায় বোধ করবেন। দস্যি প্রাণটাকে পেটের ভিতরে শুধু একটু শান্ত থাকতে বলছিলেন সেই মা।
“আমার এই কথাটুকু ও শুনেছিল ভাগ্যিস!” শনিবার বিকেলে ঠাকুরপুকুরে বাপের বাড়িতে এক মাসের তুলোর পুঁটলিটিকে কোলে নিয়ে হাসছিলেন গরবিনী মা! “ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ঘণ্টা চার-পাঁচ শহরে চরকিপাকের পরে কী ভাবে যে সে দিন হাসপাতালে পৌঁছেছি! ঝড় শেষের পৃথিবীতে যে কত আশা, স্বপ্ন তা পরদিন সকালে আমার সোনাকে কোলে নিয়েই বুঝলাম।”
আরও পড়ুন: রাহু-কেতুর গপ্পে জুড়ল করোনা নাশের গুজবও
সন্তানের জন্মের কথা ছিল মে-র ২৫ তারিখ। ঘূর্ণিঝড়ের আগের দিনই, রিয়ার বর দেবব্রত আসায় ঠাকুরপুকুরের বাড়িতে চিংড়ি-মাংসের ভোজ হয়। ঝড়ের দুপুরে পেটে হাল্কা ব্যথা হলেও রিয়া আমল দেননি। বিকেলে ঝড় শুরুর আগে মালুম হল, আসন্ন জীবনের পদধ্বনি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। মেটিয়াবুরুজে কাপড়ের পাইকারি কারবারি দেবব্রত তখন মহেশতলার শানপুকুরে নিজেদের বাড়িতে। তাঁকে খবর দিয়েই পাড়ার অ্যাপ-ক্যাব চালক যুবক সানি সাহাকে রিয়ার বাবা অসীম মজুমদার রাজি করিয়ে ফেললেন। সানি গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করা পর্যন্ত বাড়ির ভাড়াটে রজনী পাত্র তাঁর অটোয় হবু মায়ের সারথি হলেন। সেই গ্যারাজ অবধি এগোনোর আগেই একটি বড় গাছ ও টিনের চালের মুদির দোকানঘর মড়মড়িয়ে ভেঙে পড়ল। রিয়ার কাকা নিমাইবাবু, পরিমলবাবুরা কাটারি নিয়ে বেরিয়েছিলেন। ডালপালা ছেঁটে পথ করতে হচ্ছিল। ক্ষতবিক্ষত হাত-পা। নিঃশব্দ প্রার্থনা, দুলতে থাকা গাড়িটায় যেন গাছ না-পড়ে। তবু নেপালগঞ্জের ছোট নার্সিংহোমের রাস্তাটাই আটকে দিল গাছের শব।
অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে গলি ধরে কবরডাঙায় রিয়ার ডাক্তার বাসুদেব মণ্ডলের বাড়িতে পৌঁছনো গিয়েছিল। তিনি টর্চ নিয়ে দেখে আশ্বস্ত করেছিলেন, গর্ভস্থ সন্তান ঠিক আছে। অসীমবাবু মেয়েকে পিজি হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জল ঢুকে গাড়ি বন্ধ হওয়ার ভয় ছাড়াও ছিল বিপদের অজস্র আশঙ্কা। হরিদেবপুর থানা অবশ্য গাড়ি দিয়ে সাহায্য করতে পারেনি তাঁদের। কিন্তু বান-ডাকা নদীর মতো উপচে ওঠা রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে পুলিশই দেবদূত হয়ে দেখা দিল। টালিগঞ্জের ওসি সরোজ প্রহরাজের তৎপরতায় টালিগঞ্জ ট্র্যাফিক গার্ডের ওসি সোমনাথ মিত্র নিজেই হবু মাকে পাশে বসিয়ে সারথি হলেন। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলেন রিয়া। ভোরে নবজাতকের বাবা দেবব্রত সেখানে পৌঁছনোর কিছু পরেই লেবার রুম থেকে এল সুসংবাদ।
ছেলের নাম অনেকেই আমপান বা তুফান রাখতে বলছেন। তরুণ মা-বাবার সে সব পছন্দ নয়। এই নাছোড় জন্মের সাক্ষী, শিশুর দাদু অসীমবাবুর শ্রীকৃষ্ণের জন্মের গল্প মনে হচ্ছিল। তাঁর পছন্দের নাম দেবরূপ। শিশুর বাবা দেবব্রত নাম নিয়ে তাড়াহুড়ো চান না।
দুঃসহ ব্যথা হয়ে অবসান, ঝড়ের রাতশেষে জন্মানো শিশু মহাপ্রাণ হবে কি না পরের কথা! আনকোরা বাবা বলছেন, “এতগুলো মানুষ সাহায্য না করলে পৃথিবীতে আসাই হত না আমাদের ছেলের। ও যেন বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ায়।”
ঝড়-অতিমারিতে লড়াকু জন্ম-যোদ্ধা অবশ্য এক মাস পূর্তিতে খলখল করে হাসছে। মা দেখছেন, সে-হাসিতে ঝড়কে হারানোর জয়ধ্বজা...।