মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
অতীতেও সমস্যা হয়েছে বার বার। কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নেয়নি কোনও সরকারি হাসপাতালই। তাই প্রশ্ন উঠেছে, সঙ্কটজনক কোনও রোগীকে রাতে সরকারি হাসপাতালে আনার আগে কি দশ বার ভাবতে হবে? কারণ, বিকেল হলেই উধাও হয়ে যান সিনিয়র চিকিৎসকেরা। অগত্যা রোগীর ভরসা জুনিয়রেরা। এই অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। যার জেরে মাঝেমধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। প্রশ্ন ওঠে, রাতে সিনিয়র বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা থাকবেন না কেন? উত্তর মেলে না কারও কাছেই। রবিবার রাতে এসএসকেএমের ট্রমা কেয়ারে রোগীর পরিজনদের হামলার ঘটনাতেও উঠেছে সিনিয়র চিকিৎসক না থাকার প্রসঙ্গ। রোগীর পরিজনদের প্রশ্ন, “বার বার ঠেকেও কি সরকারি হাসপাতালের এই ছবি বদলাবে না?”
রাতে সিনিয়র চিকিৎসকদের হাসপাতালে থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এসএসকেএমে চিকিৎসকদের মারধর ও ভাঙচুর প্রসঙ্গে তিনি জানান, ঘটনার সময়ে সেখানে জুনিয়র চিকিৎসকেরা ছিলেন। সিনিয়র কেউ ছিলেন না। ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, সরকারি মেডিক্যাল কলেজে কখনওই রাতে সিনিয়র চিকিৎসকেরা থাকেন না। তাই মাঝরাতে রোগীর অবস্থা সঙ্কটজনক হলে সিনিয়র চিকিৎসককে ফোন করে পরামর্শ নিতে হয় জুনিয়রদের। হাসপাতালে রাতে সিনিয়র চিকিৎসকেরা কেন থাকেন না, তা নিয়ে অতীতে প্রশ্ন তুলেছেন জুনিয়র চিকিৎসক থেকে নার্সরাও।
২০১৫ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে রাতে রেডিয়েন্ট ওয়ার্মারে পুড়ে দুই নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছিল কর্তব্যরত নার্সকে। এক মাস সাসপেন্ড হন তিন পিজিটি (স্নাতকোত্তরের পড়ুয়া চিকিৎসক)। জুনিয়র চিকিৎসক ও নার্সদের একাংশ অভিযোগ করেছিলেন, এসএনসিইউ-তে রাতে সিনিয়র চিকিৎসক থাকেন না। সন্ধ্যাতেও আসেন না। ভুল হলে দায় চাপে নার্স ও জুনিয়রদের উপরে। এর পরেও বিভিন্ন সময়ে কলকাতা ও রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে রাতে সিনিয়র চিকিৎসক না থাকায় বিপত্তি ঘটেছে। এসএসকেএমের ঘটনায় তাই ফের প্রশ্ন উঠেছে, রাতে কেন ডিউটি থাকে না সিনিয়রদের? সংখ্যা পর্যাপ্ত নয় বলেই কি?
স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকদের দাবি, তা নয়। দীর্ঘ দিন ধরেই রাতে সিনিয়র চিকিৎসকেরা থাকেন না। তাঁদের অধীনস্থ চিকিৎসকেরাই সবটা সামলান। শহরের এক সরকারি হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসকের কথায়, “রাতে না থাকাটা সিনিয়রদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। থাকাটা প্রয়োজন। ফোনে শুনে ওষুধ বা অন্য কিছুর ব্যবস্থা করাটা ঝুঁকির। রাতে বাড়ি থেকে আসাটাও সময়সাপেক্ষ।” একটি মেডিক্যাল কলেজের এক সিনিয়র চিকিৎসকের মতে, “মুখ্যমন্ত্রী সিনিয়র চিকিৎসক কথাটি বৃহৎ অর্থে বলেছেন। উনি সিনিয়র বলতে শিক্ষক-চিকিৎসকদের কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁদের নীচের স্তরও রয়েছে।”
স্বাস্থ্য দফতরের ব্যাখ্যা, সিনিয়র চিকিৎসক বলতে প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, অর্থাৎ যাঁরা শিক্ষক-চিকিৎসক এবং আরএমও (রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার), এসআর (সিনিয়র রেসিডেন্ট)-দের বোঝানো হয়। প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে রাতে আরএমও এবং এসআরেরা ডিউটিতে থাকেন। সঙ্গে জুনিয়র, অর্থাৎ পিজিটি ও ইন্টার্নেরা। আর এক জন করে শিক্ষক-চিকিৎসক ‘অন কল’ থাকেন। রাতে প্রয়োজনে তাঁকে খবর দেওয়া হয়। এক আধিকারিকের কথায়, “অন-কল চিকিৎসককে রাতে সজাগ থাকতে হয়। প্রয়োজনে হাসপাতালে আসতেও হয়। কিন্তু তাঁকে রাতে হাসপাতালে কাটাতে হয় না। আসলে শিক্ষক-চিকিৎসকদের সকালে পড়ানোর মতো বড় দায়িত্ব নিতে হয়।”
সূত্রের খবর, রবিবার রাতে পিজির ট্রমা কেয়ারে গন্ডগোলের সময়ে ছিলেন পিজিটি-রা। এসআর-রা অপারেশন থিয়েটারে ছিলেন। খবর পেয়ে তাঁরা আসেন বলেই দাবি কর্তৃপক্ষের। কিন্তু এ বার খোদ মুখ্যমন্ত্রী রাতে সিনিয়রদের থাকতে বলায় সেই মতো ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, ট্রমা কেয়ারের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভাগের এক জন করে শিক্ষক-চিকিৎসক রাতে ডিউটি করবেন।
কিন্তু প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরেও ছবিটা বদলাবে কি? উত্তর মিলবে ক’দিনের মধ্যেই।