সম্প্রতি মহিলা কর্মীদের সবেতন ঋতুকালীন ছুটি দিতে স্পেনে আইন পাশ হওয়ায় এ দেশেও এ নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রতীকী ছবি।
মাসের ওই ক’টা দিন কলেজে যেতে পারেন না পেশায় শিক্ষিকা প্রিয়াঙ্কা। পেটের অসহ্য যন্ত্রণায় বিছানায় ছটফট করেন। ঋতুকালীন দিনগুলিতে তলপেটের ব্যথা সামলে, দাঁতে দাঁত চেপে অফিস করতে মুঠো মুঠো ওষুধ খান সুনন্দা।
প্রিয়াঙ্কা-সুনন্দার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয় বহু মহিলাকেই। সম্প্রতি মহিলা কর্মীদের সবেতন ঋতুকালীন ছুটি দিতে স্পেনে আইন পাশ হওয়ায় এ দেশেও এ নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। ঋতুকালীন ছুটির আবেদন নিয়ে মামলা শুনতেও প্রস্তুত শীর্ষ আদালত। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ এই মামলা শুনবে।
তবে, তার আগেই এ দেশের বেশ কিছু সংস্থা ঋতু-ছুটির মতো কঠিন প্রশ্নের সহজ ও চটজলদি সমাধান বার করে ফেলেছে। কোভিড-পরবর্তী যুগে এই প্রশ্নে অনেকেরই হাতিয়ার ‘বাড়ি থেকে কাজের’ সংস্কৃতি। ঋতুকালীন সমস্যায় মহিলাদের অনেকেই পুরোপুরি ছুটি না নিয়ে বাড়ি থেকে কাজ করছেন। আর তাতে সংস্থার কাজেও ভাটা পড়ছে না। যদিও গত কয়েক বছরে সমস্ত মহিলা কর্মীর সবেতন ঋতু-ছুটি মঞ্জুর করেছে জ়োম্যাটো, সুইগি, বাইজু-র মতো বেশ কিছু সংস্থা।
কলকাতার একটি ম্যানেজমেন্ট উপদেষ্টা সংস্থার অন্যতম কর্ণধার মাধবী গুহ বসু বলছেন, ‘‘আমাদের সংস্থায় ঋতু-ছুটির বিষয়টি কার কতটা প্রয়োজন, সেই ভিত্তিতে দেখা হয়। প্রয়োজনে বাড়ি থেকে কাজের সুযোগও রয়েছে, যাতে অফিসের কাজের ক্ষতি না হয়।’’ বিভিন্ন সংস্থায় চুক্তির ভিত্তিতে কর্মীর জোগান দেওয়া সংস্থাগুলির সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান স্টাফিং অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রেসিডেন্ট লোহিত ভাটিয়ার কথায়, ‘‘আমাদের সংস্থাতেও ঋতুকালীন দিনগুলিতে ছুটি অথবা বাড়ি থেকে কাজ— এই দুই বিকল্প রয়েছে। বহু বড় সংস্থাও এ ভাবেই কাজ চালাচ্ছে। তবে, ছোট সংস্থা বা ছোট শিল্পে (যেখানে বাড়ি থেকে কাজের সুযোগ নেই) মহিলা কর্মীদের সবেতন ঋতু-ছুটি দেওয়া অথবা সে জন্য অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। তাই সেখানে ঋতুকালীন ছুটির কথা এখনও ভাবা হচ্ছে না।’’
ভারতের মতো রক্ষণশীল দেশে আজও ঋতুকালীন সমস্যা থাকে গোপনীয়তার আড়ালে। প্রকাশ্যে ঋতু-ছুটি চাইতেও পারেন না অনেকে। অথচ, এই সময়ে নানা শারীরিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাঁদের। স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘দেশের চার কোটিরও বেশি মহিলা এন্ডোমেট্রিয়োসিস রোগে ভুগছেন। এতে ঋতুস্রাবের রক্তের একাংশ নিম্ননালির মাধ্যমে পেটের মধ্যেই থাকে এবং জরায়ুর উপরে জমে সিস্ট তৈরি করে। এই রোগে ঋতুকালীন সময়ে তলপেটে প্রবল ব্যথা, অবসাদ, ক্লান্তি, ডিসমেনোরিয়া-সহ একাধিক উপসর্গ দেখা দেয়। বন্ধ্যত্বও আসতে পারে। এ ছাড়া, ফাইব্রয়েড জরায়ুর ক্ষেত্রেও নানা ঋতু-সমস্যা হয়। কখনও তা জিনগত। এ সব ক্ষেত্রে ঋতুকালীন কষ্ট কমাতে ছুটি অত্যন্ত জরুরি।’’
ইউরোপে ঋতু-ছুটির বিষয়ে স্পেনই পথপ্রদর্শক। এশিয়ায় চিন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো হাতে গোনা কয়েকটি দেশে ঋতু-ছুটি দেওয়া হয়। ভারতে সরকারি ভাবে এই ছুটি দেয় শুধুমাত্র বিহার সরকার (১৯৯২ সাল থেকে)।
তবে, এ দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রে ঋতু-ছুটি মহিলা কর্মীদের জন্য ‘বুমেরাং’ হতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকেরই। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের কর্মরত মহিলাদের ৮৫ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে রয়েছেন। সেখানে অনেক সময়ে মাতৃত্বকালীন ছুটিও মেলে শুধু খাতায়-কলমে! ফলে ঋতু-ছুটি চালু হলে তার মাসুল হিসাবে মেয়েদের কাজ হারানোর ভয় থাকছে ষোলো আনা। বাড়তে পারে নিয়োগ-বৈষম্য ও বেতন-বৈষম্যও।
অধ্যাপিকা ও সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষের আশঙ্কা, ঋতু-ছুটি কাঙ্ক্ষিত হলেও তা সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা কর্মীদের মধ্যেও বৈষম্য আনতে পারে। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘প্রতি মাসে ঋতু-ছুটি দিতে হলে সংস্থার উৎপাদন ক্ষমতা কমবে এবং ব্যয় বাড়বে। এর মূল্য একা নিয়োগকর্তাকে দিতে হলে তিনি ভবিষ্যতে মহিলা কর্মী নিয়োগে বিমুখ হতেই পারেন। মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে হবে বলে মহিলা কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনা তো আগেও ঘটেছে। তাই সব পক্ষের সুরক্ষার কথাই ভাবতে হবে সরকারকে।’’