গত বছরের দোলের কলকাতার সওদা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
দোলের দিন। সে সময় উত্তর কলকাতার কীর্তি মিত্র লেনের বাসিন্দা বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি দল সর্বাঙ্গে আবির মেখে কাছাকাছি বসবাসকারী পরিচিতদের রং মাখাতে তাদের বাড়িতে হামলা করতেন। ১৯৩৪ সালে মোহনবাগান রো-নিবাসী পরিমল গোস্বামী তাঁদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে সেই দলে যোগ দিতে বাধ্য হলেন। দলের পরবর্তী লক্ষ্য হল মোহনলাল স্ট্রিটের মুখে নলিনীকান্ত সরকারের ফ্ল্যাট। কড়া নেড়ে ডাকতেই বাড়ির ম্যালেরিয়া-আক্রান্ত গৃহসহায়ক মোটা কম্বলে আপাদমস্তক জড়িয়ে গোঙাতে গোঙাতে জানাল যে বাবু বাড়ি নেই। মিছিল হতাশ হয়ে ফিরে এল। তবে সন্ধ্যায় জানা গেল যে সংবাদবাহী পরিচারক আর কেউ নয়, ছিলেন নলিনীকান্ত স্বয়ং! পরিমল গোস্বামী স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, দোল-সন্ধ্যায় তখন তাঁরা স্তম্ভিত।
শুধু নিজে রং মাখলেই হল না। অন্যকেও রঙিন করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে দোলের আনন্দ। উনিশ শতকের কলকাতাতেও প্রাণকৃষ্ণ দত্ত দেখেছেন, গানবাজনা সহকারে নাচতে নাচতে দোলের মিছিল যে রাস্তা দিয়েই যেত, সেখানে কারও কাপড় ‘বেদাগ’ থাকত না। পিচকিরি আবিরে পথঘাট বাড়িঘর লালে লাল হয়ে যেত। মিছিলওয়ালারা সুশ্রাব্য অশ্রাব্য গানে পাড়া মাতিয়ে সামনে যাকে পেত তাকেই পিচকারি-আবিরে ব্যতিব্যস্ত করে চলে যেত।
স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের বয়ানে পাওয়া যায়, উনিশ শতকের সত্তর-আশির দশকে আবির গুলে তরল রং তৈরির কথা। ‘ম্যাজেন্ডার’ বা কৃত্রিম রং বাজারে এসেছে অনেক পরে। তা ছাড়াও শোলার ‘নুটি’র মধ্যে কুমকুম ভরে ছোড়া হত। তবে এই নুটি আর আধুনিক সময়ের বেলুনের মাঝে, দোলের সময় রঙের মিসাইল হিসাবে ব্যবহার হত মোমের ডিম। সিরিঞ্জের নল দিয়ে তার মধ্যে তরল রং ভরা হত, ছুড়ে মারলেই মোমের পাতলা আস্তরণ ফেটে ছড়িয়ে পড়ত রং। বেলুনের তুলনায় পরিবেশবান্ধব এই মোমের ডিম তৈরির জন্য বিশেষ ছাঁচ বিক্রি হত কলকাতার কিছু অঞ্চলে। দোলের আগের দিন সারা দুপুর-বিকেল বসে এই রং-ভরা ডিম বানানোর আনন্দ আজও মনে থাকতে পারে পুরনো কলকাতাবাসীর। ছোটদের দোলের আর একটি মজা ছিল আলুর মধ্যে উল্টো হরফে ‘গাধা’, ‘বোকা’ শব্দ খোদাই করে রাখা। দোলের দিন সেই আলু রঙে চুবিয়ে চুপি চুপি বন্ধুদের পিঠে ছাপ দিলেই সোজা হয়ে লেখা ফুটে উঠত। সে নিজে বোঝার আগে পড়ে ফেলত সারা পাড়া।
বালতি-ভরা লাল জলে টিনের পিচকারি ডুবিয়ে সামনে পাওয়া মানুষটির গায়ে ছেটানোর মধ্যেই দোলের মজার স্বাদ পেয়েছিলেন শিশু অবনীন্দ্রনাথ। দেউড়ির দারোয়ান ‘মনোহর সিং’-এর ধবধবে, লম্বা সাদা দাড়িতে সারা বছরের হাত বোলানোর ইচ্ছে পূর্ণ হত শুধু দোলের দিন আবির মাখানোর সময়। এমনটাই ছিল দোলের নির্দোষ আনন্দ, যার অনেকটাই আজ রূপ পাল্টেছে, কিছু মুছে গিয়েছে জনজীবন থেকে।
কথাশিল্পী
বড় ছেলে ডাক্তার, মেজো ইঞ্জিনিয়ার। ছোটটিও বেছে নেবে এমনই কোনও পেশা, বাবার ইচ্ছা৷ স্রোতের উজানে গিয়ে সেই ছেলেই বেছে নিল সাহিত্য৷ বাংলায় এমএ পাশ করে, রেলের চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রদেশে কাটিয়েছেন বহু বছর৷ দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে সাহেব বিবি গোলাম প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিমল মিত্রের (ছবি); রেলের চাকরি ছেড়ে শুরু করেন পূর্ণসময়ের সাহিত্যসেবা। কয়েকশো গল্প, ৭০টি উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি, অনুবাদগ্রন্থ— সব মিলিয়ে তিনি এক সার্থক কথাশিল্পী৷ সভা-সমিতি, আড্ডায় বেশি পাওয়া যেত না, একান্তে লেখালিখিই ভালবাসতেন৷ ভারতীয় প্রধান ভাষাগুলিতে অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা, পেয়েছেন নানা সাহিত্য সম্মাননা, প্রয়াণের তিন দশক পরেও পাঠকের আদৃত৷ গত ১৮ মার্চ ১১২তম জন্মবার্ষিকীতে স্মরণানুষ্ঠান হয়ে গেল তাঁর চেতলার বাড়িতে৷ রচনাবলি ধরে আছে তাঁর সৃষ্টি, ত্রয়োদশ খণ্ডটি প্রকাশিত সম্প্রতি।
— ফাইল চিত্র।
এক, অনেক
১৯৬১-র হিসাবে ভারতে ১৬৫২টি মাতৃভাষার অস্তিত্ব জানা যায়, এর বাইরেও ছিল আরও ভাষা। এত বড় দেশে তা কি সংহতির সঙ্কট হবে? না কি ভাষিক রুচির অধিকার স্বীকার করে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য তৈরিই হবে লক্ষ্য! ভারতীয় ভাষা সমিতির সহায়তায়, ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ় আজ শ্রীঅরবিন্দ ভবনে আয়োজন করেছে আলোচনাসভা, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ় ও শ্রীঅরবিন্দ ভবনের সঽযোগিতায়। ভাষা ও জাতীয় সংহতি, ভাষা-মানচিত্রে বাংলার অবস্থান, সমস্যা ও সম্ভাবনা, আঞ্চলিক ভাষা প্রসারে প্রযুক্তি, বিচারব্যবস্থায় আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নিয়ে বলবেন কৃতবিদ্যেরা। থাকবেন কে এস রাও, প্রাক্তন বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় ও শ্যামল সেন, কিশোর দত্ত, জয়ন্ত মিত্র প্রমুখ। থাকছে প্রদর্শনীও: আঞ্চলিক ভাষা ও আধুনিক প্রযুক্তি, মনীষীদের দৃষ্টিতে বাংলা ভাষা নিয়ে।
পটে লিখা
মহাত্মা গান্ধীর পরামর্শে ১৯৩৪-এ ‘সুলেখা’ কালির যাত্রা শুরু। ‘সু’ অর্থাৎ ভাল লেখা যায় বলে নাম ‘সুলেখা’। স্বদেশি এই কালির প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর সত্যজিৎ রায়ও বার বার তার কথা লিখেছেন ফেলুদা-কাহিনিতে, তাঁর ছবিতেও দেখা গিয়েছে সুলেখার দোয়াত। কলকাতার এই সংস্থাটি আগামী ২৭ ও ২৮ মার্চ, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্কে আয়োজন করেছে ‘ফ্রিউইংস ইঙ্কহার্ট’ গ্রুপের চোদ্দো জন শিল্পীর প্রায় সত্তরটি আঁকা ছবির প্রদর্শনী। সম্পূর্ণ সুলেখা কালি দিয়ে আঁকা, এমন বেশ কিছু ছবিও থাকছে তার মধ্যে। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে হবে কর্মশালাও। উপস্থিত থাকবেন শিল্পী যোগেন চৌধুরী-সহ বিশিষ্টজন।
শতবর্ষ পরে
‘সিভিল অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসেস অ্যাসোসিয়েশন’, মূলত এজি বেঙ্গল-এর অবসরপ্রাপ্তকর্মীদের সংগঠন। ১৯২০ সালে জন্ম, স্বীকৃতি ১৯২২-এ। শতবর্ষ পেরোনো সংগঠনটি সম্প্রতি ট্রেজারি বিল্ডিং ইনস্টিটিউট হল-এ এক অনুষ্ঠানে উদ্যাপন করল এই ঐতিহাসিক অভিযাত্রা, ফিরে দেখল অতীতের নেতৃবৃন্দ ও কর্মচারীদের লড়াই ও আন্দোলনকে। অধ্যাপক রতন খাসনবিশ বললেন ‘কর্মচারী আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িক বিপদ’ নিয়ে, প্রাক্তন ও বর্তমান কর্মীরা মিলে মঞ্চস্থ করলেন নাটক মানুষ সত্য, কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ের রচনা, নির্দেশনায় অনুপ ঘোষ। প্রকাশিত হল শতবর্ষ স্মারকগ্রন্থও।
উৎসবনাট্য
ফেলে আসা দূরের দশকগুলিতে যে পাড়ায় ছিল ছোটখাটো বাড়ি, চড়ুইয়ের ডাক, সেখানে এখন মোবাইলের শব্দ, বহুতল, সাইবার যুগ। তবু বসন্ত আসে, সারা রাত জেগে থাকে চাঁদ। এই নিয়েই রাসবিহারী শৈলুষিক-এর সাম্প্রতিক প্রযোজনা গোধূলি গগনে (নির্দেশনা: পদ্মনাভ দাশগুপ্ত), মঞ্চস্থ হবে ২৯-৩১ মার্চ তাদের নাট্য উৎসবে প্রথম দিন দুপুর আড়াইটায় রবীন্দ্র সদনে, জানালেন দলের কর্ণধার কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। দুপুর সাড়ে ১২টায় উৎসব উদ্বোধনে পৌলমী চট্টোপাধ্যায়, সম্মানিত হবেন শঙ্কর চক্রবর্তী অরূপ রায় ও অর্পিতা ঘোষ। রবীন্দ্র সদনে দেখা যাবে চেতনা-র মহাত্মা বনাম গান্ধী, ঠাকুরনগর প্রতিধ্বনি-র ফেলে আসা মেগাহার্টজ়, ইচ্ছেমতো-র কিত্তনখোলা, নৈহাটি নাট্যসমন্বয়-এর ফেরারী ফৌজ; শেষ সন্ধ্যায় অ্যাকাডেমি মঞ্চে মুখোমুখি নাট্যদলের টিনের তলোয়ার।
সুবর্ণযাত্রা
কলকাতা বন্দরের স্থান নির্বাচন হয়েছিল, ইংরেজ এই স্থান নোঙর ফেলার উপযুক্ত বিবেচনা করেছিল বলে। ক্রমে বন্দরের বিস্তার, হুগলি নদী দিয়ে নতুন নতুন জাহাজের আগমন। শুধু কলকাতা ও হলদিয়া দিয়ে ফি-বছর কমবেশি সাড়ে তিন হাজার ভিনদেশি জাহাজ চলাচল করে এখন। উত্তমকুমার, অমিতাভ বচ্চনের কর্মজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলকাতা বন্দর, কলকাতার জাহাজ কোম্পানি। পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো জাহাজি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব শিপিং ইন্টারেস্টস ইন ক্যালকাটা (এসিক) পঞ্চাশ পূর্ণ করল। অর্ধশতকের যাত্রায় প্রকাশ পেল স্মারকগ্রন্থ হরাইজনস (মুখ্য সম্পাদক বন্দর-ঐতিহ্য গবেষক গৌতম চক্রবর্তী); প্রশাসক, গবেষক, নৌসঞ্চালক, অর্থনীতিবিদের লেখায় ঋদ্ধ। গত ১৬ মার্চ রাজভবনে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করলেন মাননীয় রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। ছবিতে অতীতের ‘মে ডলার’ জাহাজ (বামে), কলকাতা বন্দরে জাহাজের ভিড়।
— ফাইল চিত্র।
মূর্ত-বিমূর্ত
ব্রহ্মপুত্রে জল বেশি হলে ভাসাত বাড়ির উঠোনও। জামালপুরের সেই ছেলেই, যখন হাতে নিলেন রংতুলি, ক্যানভাসে ধরা দিল পূর্ববঙ্গের জল মাটি নদী হাওয়া। তার পর দেশ, ঠিকানা পাল্টাল, সেই সঙ্গে গণেশ হালুইয়ের ছবিও, তার ভাবনা দর্শন, ব্যাকরণ-প্রকরণ: মূর্ত নিসর্গ থেকে বিমূর্ত রসের দিকে। সুদীর্ঘ শিল্পযাত্রায় তাঁর ছয় দশকের চিত্রকৃতির বাছাই বৃহদংশ এ বার প্রদর্শনীতে ফিরে দেখবে কলকাতা। বিড়লা অ্যাকাডেমিতে গত ১ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে ‘গণেশ হালুই/ রি-সাইটেশনস: রাইমস অ্যাবাউট ল্যান্ড, ওয়াটার অ্যাল্ড স্কাই’ নামের প্রদর্শনী (ছবি), কিরণ নাদার মিউজ়িয়ম অব আর্ট-এর উদ্যোগে, রুবিনা কারোদে-র কিউরেশনে। দেখা যাবে ওঁর গুয়াশ অন পেপার, জাপানিজ় স্ক্রোল পেপারে চিনা কালির ড্রয়িং, টেম্পেরার কাজ; ওঁর বিখ্যাত অজন্তা-চিত্রকৃতিরও কয়েকটি। ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত, সোমবার ও ছুটির দিন বাদে ৩টা-৮টা।
ছবিঃ সংগৃহীত।
রহো সাথে
কোভিডের স্মৃতি মোছার নয়। অতিমারিতে আক্রান্ত হয়ে অগণিত সহনাগরিক চলে যাওয়ার সময় সঙ্গী হয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিকতার কঠোরতা, এক প্রকার সামাজিক নির্লিপ্তিও। বিজ্ঞানবিধি, নিয়মতন্ত্রের কাছে হেরে গিয়েছিল নিকটজনের আবেগ, অধিকার। বিদায় নেওয়া মানুষেরা শেষ মুহূর্তে নিকটজনকে কাছে পাননি, প্রিয়বিয়োগে স্বজন-বন্ধুদের পাশে দাঁড়ানোর মনও কুঁকড়ে ছিল ভয়ে। করোনাকালে যাঁদের হারিয়েছি, তাঁদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাতে তৈরি হয় ন্যাশনাল কোভিড মেমোরিয়াল (www.nationalcovidmemorial.org)। বৈদ্যুতিন এই মঞ্চ আত্মজনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও স্মরণের পরিসর হিসেবে ক্রমপ্রসারিত। আজ, ২৩ মার্চ ভারতে করোনার সংক্রমণের প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণার চার বছর পূর্ণ হচ্ছে। কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্ক-এর উদ্যোগে ২৪ মার্চ, রবিবার বিকাল ৫টায় স্মরণ অনুষ্ঠান, মোহর কুঞ্জে।