করোনা আতঙ্কে এ ভাবেই কমছে অপরাধ। গ্রাফিক— তিয়াসা দাস।
২৩ মার্চ, সোমবার: গোটা কলকাতা পুলিশ এলাকায় ৩০টি এফআইআর দায়ের। তার মধ্যে ১৩টি মামলাই লকডাউন অমান্য করে রাস্তায় ভিড় জমানোর জন্য। বাকি ১৭টির মধ্যে দু’টি চুরির অভিযোগ। বাকি অভিযোগগুলি মূলত পারিবারিক গন্ডগোলের জেরে মারপিট এবং বেপরোয়া গাড়ি চালানোর অভিযোগ।
২৪ মার্চ, মঙ্গলবার: কলকাতা পুলিশ এলাকায় ৩০টি এফআইআর দায়ের। তার মধ্যে ২০টি মামলাই লকডাউন অমান্য করার জন্য। ছোটখাটো মারামারির অভিযোগ ৪টি। বেআইনি নির্মাণ কাজের বিরুদ্ধে পুরসভার করা মামলা ২টি। বাকি চারটি ছোটখাটো প্রতারণার পুরনো অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা।
রাজ্যে শুরু হওয়া লকডাউনের প্রথম দু’দিন এমনটাই কলকাতা শহরের অপরাধের গ্রাফ। করোনা নিয়ে গোটা দেশ জুড়ে আতঙ্কের মধ্যে এটাই আপাতত স্বস্তি কলকাতা পুলিশের। অপরাধীদের মধ্যেও সেঁধিয়ে গিয়েছে ভাইরাসের আতঙ্ক।
আরও পড়ুন: লকডাউনে অ্যাম্বুল্যান্স মেলেনি, পুলিশভ্যানেই সন্তানের জন্ম সোনারপুরে
বুধবার দুপুরে কলকাতার পূর্ব শহরতলি বিভাগের একটি থানার ওসি বলেন, ‘‘গত দু’দিনে লকডাউন অমান্য করার মামলা ছাড়া আর অন্য কোনও অপরাধের অভিযোগ আসেনি আমার থানায়।” তাঁর কথায়, ‘‘সারা দিন কেটে যাচ্ছে রাস্তা থেকে ভিড় সরাতে। এর পর যদি ক্রাইম শুরু হয় তা হলে মুশকিল।” কলকাতা পুলিশ মহলে বলা হয়, ওই থানায় দিনে গড়ে গোটা ১০ এফআইআর লেখা না হলে বুঝে নিতে হবে কোথাও বড়সড় গন্ডগোল হয়েছে।
তবে গোটা শহর জুড়েই বিভিন্ন থানার আধিকারিকদের অভিজ্ঞতা একই রকম— গত দু’দিনে প্রায় অপরাধশূন্য গোটা শহর। পূর্ব কলকাতার একটি থানার আধিকারিকও বলেন, ‘‘কয়েকটি ছোটখাটো মারপিটের ঘটনা ছাড়া কোনও অপরাধের অভিযোগ নেই।” এই থানাতেও প্রতি দিনই চুরি, পকেটমারির মতো অপরাধের বেশ কয়েকটি অভিযোগ আসে প্রায় প্রতি দিনই।
কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ আধিকারিক বলেন, ‘‘অপরাধের এই গ্রাফ গত দু’দিনে অনেকটাই নেমেছে। তবে শহরে করোনা আক্রান্তের সন্ধান মেলার পর থেকেই এই গ্রাফ নিম্নমুখী।” তিনি আরও বলেন, ‘‘গত ৭ দিনে ৩০০টি বিভিন্ন ধরনের অপরাধের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে কলকাতা পুলিশ এলাকায়। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ওই ৭ দিনে ৬৬০টি অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছিল। অর্থাৎ ১২০ শতাংশ বেশি।”
আরও পড়ুন: কান ধরে ওঠবোস, লাঠিপেটা করে ‘লকডাউন’ করল পুলিশ, বাহবা আমজনতার
কলকাতা পুলিশের অন্য এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এ মাসের ১০ তারিখের পর থেকেই শহরে অপরাধের সংখ্যা কমে এসেছে।’’ তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘‘১৩ মার্চ থেকেই শহরের বিভিন্ন স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকেই ধীরে ধীরে সিনেমা হল, আদালত, অফিস বন্ধ হতে শুরু করে গোটা শহরে। তখন থেকে অপরাধের সংখ্যাও কমছে।’’
গত ১৩ মার্চ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত কলকাতা পুলিশের হিসাবে চুরি, ছিনতাই, পকেটমারি, রাস্তায় মহিলাদের সঙ্গে অভব্যতা-র মতো অপরাধ কমে গিয়েছিল প্রায় ২২ শতাংশ। মধ্য কলকাতার এক আধিকারিক বলেন, ‘‘মোবাইল হারানো বা চুরির ঘটনা বাদ দিয়ে গড়ে প্রতি দিন আমাদের থানায় ৫ থেকে ৭টি বিভিন্ন ধরনের অপরাধের অভিযোগ দায়ের হয়। ফেব্রুয়ারি মাসের হিসেবও এমনটাই ছিল। বর্তমানে তা কমে দৈনিক ১-২টি অভিযোগে নেমেছে।’’
তবে কি অপরাধীদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক?
কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘রাস্তায় লোকজন নেই। ট্রেন-বাস নেই। ফলে মোবাইল চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ কমে যাবে স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে বাড়িতে সবাই থাকায় চুরির চেষ্টা করবে না চোরেরা। ডাকাতি বা বড় কোনও অপরাধ করার ক্ষেত্রেও এই ফাঁকা রাস্তাঘাট অপরাধীদের পক্ষে বিপজ্জনক।” ওই আধিকারিক জানান, শহরের অধিকাংশ নির্মাণকাজ বন্ধ। ব্যবসা বন্ধ। ফলে তোলাবাজির অভিযোগও নেই। একই ভাবে মাদক পাচার গাড়ি চুরি, বাইক চুরিরও সুযোগ নেই এই পরিস্থিতিতে। ফলে সেই ধরনের অপরাধের ঘটনাও ঘটছে না।
আরও পড়ুন: বাড়ি বাড়ি বৃদ্ধাশ্রম, এই লকডাউনে কী ভাবে কাটছে ওঁদের?
সেই সঙ্গে শহরে যে সমস্ত অপরাধীরা সক্রিয়, তাদের মধ্যেও যে করোনা-আতঙ্ক সেঁধিয়ে গিয়েছে তা-ও মানছেন পুলিশ কর্তারা। এক গোয়েন্দা আধিকারিক বলেন, ‘‘দমদম সেন্ট্রাল জেলের ঘটনা দেখে বুঝতে পারছেন না? বাইরে যারা রয়েছে তাদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক।” আর তার জেরেই ‘কাজ-কর্ম’ বন্ধ নানা মাপের ‘ওস্তাদ’দের।
কিন্তু কত দিন নিশ্চিন্ত থাকা যাবে?
দীর্ঘ তিন সপ্তাহের লকডাউন কিন্তু পুলিশের চিন্তা বাড়িয়েছে। এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, ‘‘বড় অপরাধীরা তিন সপ্তাহ চুপ করে বসে থাকতে পারবে। কিন্তু মুশকিল হল ছোটখাটো চোর-পকেটমারদের মতো অপরাধীদের নিয়ে। দীর্ঘ দিন রোজগার না থাকার পর তারা মরিয়া হয়ে উঠবে রোজগারের জন্য। সে ক্ষেত্রে শহরের লোকালয়ে লুটপাটের সম্ভাবনা তৈরি হবে। তা নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে আমাদের।”
সেই সঙ্গে পুলিশের চিন্তার আরও একটি কারণ রয়েছে। এক আধিকারিক বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে জেল বন্দিদের এই পরিস্থিতিতে জামিনে মুক্তি দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে। অর্থাৎ জেলবন্দি দুষ্কৃতীদেরও একটা বড় অংশ মুক্তি পাবে। তার পর এই গ্রাফ কতটা নিম্নমুখী থাকবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।”
তবে শুধু অপরাধ নয়, এই সময়টায় কমেছে শহরে দূষণের মাত্রাও। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রেকর্ড থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৩ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত সময়ে গড়ে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা (পিএম-১০)-র মাত্রা ঘোরাফেরা করেছে প্রতি ঘনমিটারে ১০৯ মাইক্রোগ্রামের কাছাকাছি। পিএম-২.৫-এর গড় ছিল ৫৫ মাইক্রোগ্রামের আশপাশে। ফেব্রুয়ারিতে একই দিনগুলোতে গড় ছিল যথাক্রমে ২১৫ মাইক্রোগ্রাম ও ১০২ মাইক্রোগ্রামের কাছাকাছি। অর্থাৎ এক মাস আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের এক আধিকারিক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘’১৩ তারিখ থেকেই শহরে যানবাহনের পরিমাণ কমে গিয়েছিল। ২২ তারিখ পর্যন্ত হিসেব করে দেখা গিয়েছে রাস্তায় নামা গাড়ির সংখ্যা কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।’’