ফাইল চিত্র।
দেবী জানালেন, ‘‘সুরথ, তুমি আবার সিংহাসন ফিরে পাবে। সমাধি, তোমাকে মায়া থেকে মুক্তিলাভের ব্রহ্মজ্ঞান দিলাম।’’
রাজা সুরথ রাজ্য হারিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে সমাধি নামে এক বণিকও ছিলেন। ওই অরণ্যে মেধা নামে এক ঋষি তাঁদের চণ্ডীস্তব করতে বলেছিলেন। অতঃপর দেবীর আগমন। পূর্ব দিগন্তে মহাষষ্ঠীর অরুণিমা।
সুরথ ইতস্তত করে বললেন, ‘‘দেবী, একটা প্রশ্ন করব? সমাধি এবং আমি, দু’জনেই কৌতূহলী।’’ দেবী বরাভয় দিলেন। রাজা বললেন, ‘‘দেখলাম, বহু বছর পরে যে বৈবস্বত মনুর কল্প আরম্ভ হবে, সেখানে এক মহানগরী...নাম কলকাতা…।’’
সমাধি বললেন, ‘‘মা, সেই নগরীর এক দিকে রাস্তা আটকে মণ্ডপ, অন্য দিকে বড় বড় বহুতল। এই সুরথের রাজপ্রাসাদও অত উঁচু নয়।’’
‘‘সবই বৈবস্বত মনুর সময়ে হবে রে! ওগুলিকে হাউজিং কমপ্লেক্স বলে।’’
সুরথ আপ্লুত, ‘‘ওই নৃপতিরাই আপনার পুজো করবেন, দেবী?’’
‘‘কোনও নৃপতি থাকবে না,’’ দেবী বললেন, ‘‘কমপ্লেক্সগুলিতে পুজো কমিটি থাকবে। তারাই বোধন থেকে বিসর্জন, সব ব্যবস্থা করবে।’’
নৃপতি থাকবে না! দেবী হতবাক রাজাকে সান্ত্বনা দিলেন, ‘‘কমিটির প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারিরাই তখন দিন কয়েক ক্ষাত্রতেজে গমগম করবেন। তাঁরাই প্রতিমা থেকে পুরোহিত, কেটারার থেকে ঢাকি বা আলো— সব কিছুর বন্দোবস্ত করবেন।’’
‘‘এই তেজস্বী রাজাদের আয়ু কত বছর?’’ প্রশ্ন করলেন রাজ্যহারা সুরথ।
‘‘বড়জোর এক বছর। পরের বার আবার নতুন মহীপতি, নতুন কমিটি,’’ দেবীর চোখে কৌতুক, ‘‘আর রাজ্য? কমপ্লেক্সগুলিতে এইচআইজি, এমআইজি, এলআইজি নানা ভাগ থাকবে।’’
বৈশ্য সমাধি হাসলেন, ‘‘ও আমি দেখে ফেলেছি মা। মানে, আয়ের ভিত্তিতে হায়ার ইনকাম, লোয়ার ইনকাম গ্রুপ! এলআইজি-র ফ্ল্যাটগুলি ছোট, এক কামরার। এইচআইজি এক থেকে দুই হাজার স্কোয়ার ফুট।’’ মনের উৎফুল্ল ভাব গোপন করলেন না তিনি, ‘‘এই যে আয় এবং স্কোয়ার ফুটে মনুষ্যত্বের পরিমাপ... আপনার প্রসাদে ভাবীকালের ওই বৈশ্য সভ্যতা জয়যুক্ত হোক, দেবী।’’
‘‘বৈশ্য সভ্যতা বলে কিছু নেই,’’ দেবী জানালেন, ‘‘ওখানেও ব্রাহ্মণ্যবাদ থাকবে। ধরো, এলআইজি-র পুজোয় যারা সব থেকে বেশি বিজ্ঞাপন আনতে পারবে, তারা সেখানকার ব্রাহ্মণ। এইচআইজি-তেও সকলে সমান নয়। যে বেশি বিজ্ঞাপন আনবে, প্রতিমা স্পনসর করবে— সে-ই হবে দ্বিজশ্রেষ্ঠ।’’
ক্ষত্রিয় সুরথ প্রশ্ন করলেন, ‘‘এই সব এইচআইজি, এমআইজি রাজ্যের সীমানা কি পৃথক?’’
‘‘কোথাও পাঁচিল, আলাদা গেট। পুজোও আলাদা। কোথাও আবার একই সঙ্গে পুজো, কিন্তু ভিতরে প্রাচীর থেকে যাবে। সুরথ, দিব্যদৃষ্টিতে নতুন কয়েকটা কমপ্লেক্স দেখতে পাবি। এক জায়গায় পুজো হত এইচআইজি-র কোণে। কয়েক বছর পরে ঠিক হল, এ বার এমআইজি-র সামনে। এইচআইজি প্রবল চেঁচেমেচি করল, জেনারেল মিটিংয়ে মণ্ডপের এই জায়গাটা ঠিক হয়েছিল। এমআইজি, এলআইজি-রা পাল্টা উত্তর দিল, তা হলে সেই মিটিং-এর মিনিটস দেখান। দেখাবে কী, মিটিংটাই তো হয়নি।’’
সুরথ এ বার অন্য কথা জানতে চাইলেন। ‘‘দেবী, এইচআইজি আর এলআইজি-র পূজারীতি কি আলাদা?’’
‘‘উপচার সর্বত্র প্রায় এক,’’ দেবী জানালেন, ‘‘দুপুরে সকলে মিলে পংক্তিভোজন। সেখানেই গোলমাল বাধে। এ বলে, মাছের সাইজ এ বার ছোট। ও বলে, দইটা খারাপ। রাতে বিচিত্রানুষ্ঠান। সন্ধ্যায় ছোটরা, পরে বড়রা। অষ্টমী বা নবমীর রাতে নাটক। ডোনেশন বেশি হলে বড় রোল বাঁধা, অভিনয় না জানলেও।’’
সুরথ বললেন, ‘‘বৈবস্বত মনুর কল্পে কার্ল মার্ক্স নামে এক যবন ঋষি আবির্ভূত হবেন। তাঁর কথা ভেবেই একটা প্রশ্ন। এলআইজি আর এইচআইজি-র গোলমাল কি শ্রেণিসংগ্রাম?’’
দেবী হাসলেন, ‘‘না, ওই সব দ্বাররক্ষীশোভিত চত্বরে সংগ্রাম নেই। কমপ্লেক্সের বাইরের মাছওয়ালা দামের বেলায় এলআইজি-এইচআইজি তফাত করে না। আর এলআইজি মানে গরিব, এমন নয়। সে হয়তো অন্য জায়গায় এইচআইজি। এখানে পাঁচ লাখের ফ্ল্যাট কুড়ি লাখে কিনেছে। ভবিষ্যতে হয়তো তিরিশ লাখে বেচে দেবে। এইচআইজি-ও একটা শ্রেণি নয়। যার দুটো গাড়ি, সে একটি গাড়ির প্রতিবেশীকে নিচু চোখে দেখে। দু’হাজার স্কোয়ার ফুট ভাবে, হাজার স্কোয়ার ফুট নামেই এইচআইজি। পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। সকলেই মোহে আচ্ছন্ন।’’
ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য দেবীকে ফের প্রণিপাত করলেন, ‘‘জানি, আপনিই কালরাত্রি এবং মহামায়া। কমপ্লেক্স আসলে খুব কমপ্লেক্স ব্যাপার। আপনার প্রসাদ ব্যতিরেকে সেখানেও মোহমায়া ঘুচবে না।’’