ঠাসাঠাসি: হাওড়া স্টেশনের সাবওয়েতে পৌঁছনোর রাস্তার পাশে পর পর রয়েছে হকারদের স্টল। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
‘‘প্রায় ২০ বছর ধরে এখানে আসছি। গ্রাম থেকে আনাজ এনে বিক্রি করি। কিন্তু এমন জুলুমবাজি আগে কখনও দেখিনি। আমাকে বলা হয়েছে, এখানে বসতে হলে ১০০ টাকা করে রোজ দিতে হবে। না হলে নাকি বসতেই দেবে না!’’ হঠাৎ রাগের মাথায় কথাটা বলে ফেলেই সতর্ক ষাটোর্ধ্বা মহিলা। এ দিক-ও দিক দেখে, হয়তো বা নিজের সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কা করেই চুপ করে গেলেন।
যেখানে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল, সেই জায়গাটা কলকাতার দিক থেকে ডান দিক ধরে এলে হাওড়া সেতুর ফুটপাতের শেষ প্রান্ত। আর কিছুটা এগোলেই ১৩ ও ১৪ নম্বর হাওড়া সাবওয়ে ও হাওড়া স্টেশনের দিকে নামার সিঁড়ি। যে সিঁড়ি দিয়ে নেমে স্টেশনের দিকে এগোলেই চোখে পড়বে পর পর জুয়া ও সাট্টারঠেক। ওই রাস্তা ধরে স্টেশনের দিকে আরও খানিকটা গেলেই দেখা যাবে, কেএমডিএ-র জমিতে সদ্য তৈরিহওয়া ছোট একটি অফিসঘর। সেই ঘরের বাইরে পতপত করে উড়ছে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা। ঘরের ডান দিকের দেওয়ালে উত্তর হাওড়ার তৃণমূল বিধায়কের নামে বোর্ড লাগানো হয়েছে। যেন ঘরটা তাঁরই কার্যালয়। যদিও সেই বিধায়ক গৌতম চৌধুরীর দাবি, ‘‘আমি ওই অফিসে কোনও দিন যাইনি। বসিওনি। তাই কিছুই জানি না।’’ এলাকার দোকানদার ও আনাজ বিক্রেতারা জানালেন, ওই অফিসঘর তৈরির সময়েই কেএমডিএ-র ইঞ্জিনিয়ারেরা এসে সেটি ভেঙে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে ফের সেই ঘর গড়ে তোলা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ওই এলাকার দীর্ঘদিনের এক মনোহারী দোকানের মালিক বললেন, ‘‘এই অফিসঘরটা হওয়ার পর থেকেই এলাকায় তোলাবাজি বেড়ে গিয়েছে। কয়েক জন তৃণমূল নেতার মদতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তোলাবাজেরা। আমাদের ব্যবসা লাটে ওঠার মতো অবস্থা হয়েছে।’’
গত কয়েক দিন ধরে হাওড়ার লঞ্চঘাট থেকে আনাজ বাজার, এশিয়ার বৃহত্তম মাছের আড়ৎ থেকে দিঘাগামী বাসের স্ট্যান্ড— বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে জানা গেল, সর্বত্রই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুষ্কৃতীরা। বৈধ হোক বা অবৈধ, সব ধরনের ব্যবসাই চলছে তাদের অঙ্গুলিহেলনে বা সক্রিয় নিয়ন্ত্রণে। যার জেরে দোকানিরা, বিশেষত দরিদ্র হকারেরা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। সেই আতঙ্ক এতটাই যে, পরিচয় গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি পেয়েও কথা বলতে রাজি নন অধিকাংশই। ‘গুন্ডা ট্যাক্স’ দিয়ে যাওয়াটা যে তাঁদের ভবিতব্য, এটা এক রকম মেনেই নিয়েছেন সকলে।
‘গুন্ডা ট্যাক্স’ বাবদ কত করে দিতে হচ্ছে এখন?
এলাকার দোকানদার, ব্যবসায়ী ও ট্যাক্সিচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বর্তমানে হাওড়া লঞ্চঘাট থেকে দিঘা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত বসা প্রায় দেড় হাজার হকারকে ডালা (যাতেবিক্রির সামগ্রী থাকে) বসাতে প্রতিদিন দিতে হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।ছোট আনাজের ডালার জন্য ১০০ টাকা। সারা দিনে এই চত্বরে আসে প্রায় ৭০০ ট্যাক্সি। সেগুলির বেআইনি পার্কিং বাবদ দিতে হয় গাড়ি-প্রতি ২০০ টাকা। রাস্তার বেআইনি হোটেলগুলিকে দিতে হয় মাসে দু’হাজার টাকা করে। এ ছাড়াও রয়েছে, জুয়া, সাট্টা ও চোলাই মদের ঠেক। তাদের দিতে হয় মাসে ১০ হাজার টাকা। এ ভাবে তোলা নিয়ে হকার বসানোয় সরকারি জমি থেকে সাবওয়ে, সবই বেদখল হয়ে গিয়েছে। তাই নিত্যদিন এই চত্বরে আসা লক্ষাধিক মানুষের ভিড়ে হাঁটাচলাই এখন দায়। অথচ, পুলিশ ও প্রশাসন সম্পূর্ণ নির্বিকার।
হাওড়া স্টেশন চত্বরে গড়ে ওঠা এই দুষ্কৃতী-রাজ নিয়ে এক সময়ের সিপিএম নেতা তথা উত্তর হাওড়ার প্রাক্তন বিধায়ক এবং বর্তমানে জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান লগনদেও সিংহ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘যারা এই সমস্ত অন্যায় কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ সব কাজে কেউ জড়িত থাকলে দল বরদাস্ত করবে না। অবিলম্বে ব্যবস্থা নেবে।’’ এ প্রসঙ্গে হাওড়া সিটি পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘আমাদের কাছে এই ধরনের দুষ্কৃতী-দৌরাত্ম্যের অভিযোগ কেউ করেননি। তোলাবাজি, বেআইনি পার্কিং বা চোলাই মদের ঠেক বসানোর অভিযোগ পেলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেব।’’
প্রশ্ন থেকে যায়, সকলেই যখন ভয়ে তটস্থ, অভিযোগটা করবে কে? আর অভিযোগ আসার অপেক্ষাই বা করতে হবে কেন? পুলিশের কি নিজেদের উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা নেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে?
(শেষ)