গত দু’বছর বাড়ির বাইরে বেরোননি ওঁরা। ফাইল চিত্র।
অতিমারি আবহে গত দু’বছর বাড়ির বাইরে বেরোননি ওঁরা। ঘরবন্দি জীবনে ক্রমশ হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। ভিক্টোরিয়ার মাঠে গাছের তলায় প্রাক্তন ছাত্রদের হাত ধরে বহুদিন পরে একত্রিত হলেন কলকাতার হার্টলে স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিক-শিক্ষিকারা। বলছেন, ‘‘চারদিকে তো শুধু হিংসা আর যুদ্ধের খবর। এর মধ্যেই প্রাক্তন ছাত্রদের এই ভালবাসাই যে অমূল্য। এখন ওরাই আমাদের অভিভাবক।’’
কয়েক বছর আগেই শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন ওই শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কিন্তু তাঁদের ভুলতে পারেননি ছাত্রছাত্রীরা। তাই করোনা পরিস্থিতি তুলনায় ভাল হতেই গত শুক্রবার, স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের উদ্যোগে সকলে একত্রিত হলেন খোলা আকাশের নীচে। ওই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী আশিতা শাহ বলছিলেন, ‘‘রোজ প্রাতর্ভ্রমণ করতে বেরিয়ে কেবলই মনে হত, স্যর-ম্যাডামেরা কেমন আছেন? আমি সকালে হাঁটতে বেরোচ্ছি। কিন্তু ওঁদের বয়স হয়েছে, হয়তো করোনা আতঙ্কে ঘরেই বসে রয়েছেন। তখনই ঠিক করেছিলাম, পরিস্থিতি ভাল হলেই ওঁদের এক বার ভিক্টোরিয়ার মতো কোনও ফাঁকা জায়গায় নিয়ে আসব।’’
ভিক্টোরিয়ার বাগানে এই পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে ছিল কেক, লজেন্স, টুকটাক খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। ওই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা, সত্তরোর্ধ্ব অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের আনন্দ দিতে, আমাদের সঙ্গে গল্প করতে প্রত্যেকের বাড়িতে গাড়ি পাঠিয়ে ওরা এখানে নিয়ে এসেছে। করোনা-কালে গত দু’বছর দেখা হয়নি। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছে ছাত্রদের উপহার, এমনকি সারা বছরের ওষুধও পৌঁছে দিয়েছে। করোনার সময়ে আমরা কেমন আছি, সেই খোঁজখবরও নিয়েছে ওরা।’’
এত দিন পরে দেখা হয়ে শুধু খোশগল্পই নয়, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে অনুযোগও করেছেন সুনীল হরললকা, তরণজিৎ ওয়ালিয়ারা— ‘‘কোনও দিন তো ক্লাসের পরীক্ষায় দশের মধ্যে তিন-চারের বেশি নম্বর দেননি!’’ উত্তরে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বলেছেন, ‘‘কেন দিইনি জানিস? যাতে মাধ্যমিকে ভাল নম্বর পাস। ক্লাস টেস্টে ভাল নম্বর দিলে আর তো ভাল করে পড়তিস না!’’
এমন আরও কত স্মৃতি এ দিন ভেসে বেড়াল ভিক্টোরিয়ার বাগানের আনাচেকানাচে। দু’বছর পরে বাংলার শিক্ষিকা গৌরী ঘোষ, হিন্দির শিক্ষিকা হরমিন্দর চোপড়াদের সান্নিধ্য পেয়ে রীতিমতো আপ্লুত প্রাক্তন পড়ুয়ারা। এঁদের মধ্যে ৮১ বছরের হরমিন্দর এসেছেন হুইলচেয়ারে, সঙ্গী নাতনি নির্মল কৌর। হরমিন্দর বললেন, ‘‘আমার বাড়িতে পুরনো আমলের খড়খড়ির জানলা-দরজা। দরজার খড়খড়ি ফাঁক করে বাইরে যখন দেখতাম, নিজেকে বন্দি মনে হত। এত দিন পরে ওরা আমাদের বাইরে নিয়ে আসায় মুক্ত মনে হচ্ছে।’’
ক্রমশ বিকেল থেকে সন্ধ্যা নামছিল ভিক্টোরিয়ার ময়দান জুড়ে। বিশাল গাছটির নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরছিল পাখিরা। মনে হচ্ছিল, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বসে থাকা প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষিকারাও যেন তাঁদের নিজেদের ঘরেই ফিরেছেন।